ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খৎনা করাতে গিয়ে ৫ বছরের শিশুর মৃত্যু
রাজধানীর বাড্ডায় ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খৎনা করাতে গিয়ে আয়ান নামের ৫ বছরের এক শিশু মারা গেছে। সে রাজধানীর একটি বেসরকারি স্কুলের নার্সারি শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল।
আয়ানের বাবা শামিম আহমেদ অভিযোগ করেন, হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার কারণে তার সন্তানের মৃত্যু হয়েছে।
গত ৩১ ডিসেম্বর আয়ানকে ফুল অ্যানেস্থেশিয়া (জেনারেল) দিয়ে খৎনা করায় সাতারকুল বাড্ডার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। অভিভাবকদের অনুমতি ছাড়াই তার খৎনা করানো হয়ে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। অপারেশনের কয়েক ঘণ্টা পরও জ্ঞান না ফেরায় সেখান থেকে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে পাঠানো হয় আয়ানকে। সেখানে সাত দিন পিআইসিইউতে (পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) লাইফ সাপোর্টে রাখার পর রোববার (৭ জানুয়ারি) মাঝরাতের দিকে আয়ানকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।
এ ঘটনার তদন্তে ইউনাইটেড হাসপাতাল একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। রোববার (৭ জানুয়ারি) বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে আয়ানের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
শামীম আহমেদের সহকর্মী হাবিবুর রহমান বলেন, সোমবার সকালে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
হাবিবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "পুলিশকে জানানো হয়েছে। ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বাড্ডা থানার আওতাধীন; সেখানে হাসপাতালের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।"
পরিস্থিতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, "খৎনার আগের দিনও আয়ানের সব রকমের দরকারি পরীক্ষা করা হয়েছিল। আমরা সব বিষয়ে ডাক্তারদের ওপর আস্থা রেখেছিলাম, কিন্তু তাদের ভুল চিকিৎসায় আমাদের সন্তান মারা গেল।"
আয়ানের চাচা হাবিবুর রহমান আজ সোমবার (৮ জানুয়ারি) বিকেলে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আয়ানের পোস্টমর্টেম হয়ে গেছে, ওকে বরুনা বাজার এলাকায় দাফন করা হবে।
তিনি অভিযোগ করেন, আয়ানকে অপারেশন থিয়েটারে রেখে এক-দেড় ঘণ্টা ক্লাস নিয়েছেন চিকিৎসকেরা, খৎনাকে ছোট অপারেশন ভেবে চিকিৎসকদের অবহেলায় মারা গেছে আয়ান। তাদের সিসিটিভি ফুটেজ দেখলেই, ওই সময়ে ক্লাস নেয়ার সত্যতা পাওয়া যাবে। ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজে আয়ানের চিকিৎসায় যে কাগজপত্র দেওয়া হয়েছিল– সেগুলো ফেরত পাননি। শুধু ইউনাইটেড হাসপাতালের কাগজপত্রের ফাইল পেয়েছেন।
শুরুতে দশ হাজার টাকা প্যাকেজে আয়ানের খৎনা করতে ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজে যায় আয়ানের পরিবার। সেখানে যাওয়ার পর আরো তিন হাজার টাকার কিছু টেস্ট করতে হয় তাদের। মৃত্যুর পর দেখা গেছে, বিল এসেছে সাড়ে ৬ লাখ টাকা, তবে ইউনাইটেড হাসপাতাল এখন সে বিল না নিয়ে লাশ জোর করে মধ্যরাতে ফেরত দেয়।
হাবিবুর রহমান বলেন, "ইউনাইটেড হাসপাতাল একটা ভালো হাসপাতাল, সেই আস্থা থেকে আমরা কোন প্রশ্ন করিনি। যখন যে টেস্ট করাতে বলেছে, আমরাও তা করিয়েছি। আমার ভাই শুধু ডাক্তারকে বলেছিল, খৎনা করাতে বাচ্চা যেন ব্যথা না পায়। ডাক্তারদের বেশি ট্রাস্ট করার মাসুল দিতে হচ্ছে আমাদের।"
আয়ানের পরিবারের ধারণা, আয়ান আগেই মারা গেছে, নির্বাচন নিয়ে সবাই রোববার ব্যস্ত ছিল, তাই এদিন মৃত্যুর বিষয়টি ঘোষণা করা হয়– যাতে বিষয়টি মিডিয়া কাভারেজ না পায়।
জানা যায়, ৩১ ডিসেম্বর সকাল ৯টার দিকে আয়ানকে ফুল অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়া হয় ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজের সাতারকুল শাখায়। কিন্তু, বেলা ১২টার দিকেও আয়ানের সংজ্ঞা না ফিরলে– তাঁকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে ইউনাইটেডের গুলশান হাসপাতালে নেওয়া হয়।
খৎনার অপারেশনে ফুল অ্যানেস্থেশিয়া দেয়া নিরাপদ কিনা জানতে চাইলে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অ্যানেস্থেশিয়া, এনালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেন্সিভ কেয়ার মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, "খৎনায় ফুল অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়া নিরাপদ। লোকাল অ্যানেস্থেশিয়ার ড্রাগেও বাচ্চার সমস্যা হতে পারে। খৎনাকে হালকাভাবে নেয়ার কিছু নেই। তবে ড্রাগের অস্বাভাবিক রিঅ্যাকশন, বা হয়তো এমন ধরণের ড্রাগ দেয়া হলো– যে ড্রাগে বাচ্চার অ্যালার্জির কারণে সমস্যা হতে পারে। কিন্তু তা ম্যানেজ করার জন্য প্রস্তুতি রাখতে হয়। বাচ্চারা অনেক সময় ভয় পেয়ে যায়, সে কারণে শিশুদের বিষয়ে বেশি সচেতন থাকতে হয়, বাড়তি প্রস্তুতি রাখতে হয়। ইউনাটেড মেডিকেল কলেজের বিষয়টির তদন্ত হওয়া উচিৎ তাহলে আসল কারণ জানা যাবে।"
আয়ানের মৃত্যুর বিষয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালের চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ রাজা'র সাথে যোগাযোগ করা হলে– তিনি হাসপাতালের কমিউনিকেশন অফিসারের সাথে কথা বলতে বলেন।
ইউনাইটেড হাসপাতালের গণসংযোগ (পিআর) কর্মকর্তা আরিফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "আয়ানকে আমাদের গুলশানের হাসপাতালে আনার পরে, তাঁকে পিআইসিইউ এ ভর্তি করা হয়। তাঁর শারীরিক অবস্থার কথা চিন্তা করেই একটি মেডিকেল বোর্ডও গঠন করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, আমরা নিয়মিতভাবে রোগীর পরিবারের সাথে শলাপরামর্শ করেছি। রোববার (৭ জানুয়ারি) সন্ধ্যা থেকে আয়ানের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে, এবং রাত ১১টা ২০ মিনিটে সে মারা যায়।"
ইউনাইটেড গ্রুপের মালিকানাধীন হচ্ছে ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ। সেখানে রোগীর ভুল চিকিৎসা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, "বিষয়টি অনুসন্ধানে ১ জানুয়ারি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এরমধ্যেই কমিটি একটি বৈঠক করেছে। আগামী ১০ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া যাবে বলে আশা করছি। রিপোর্ট আসার পরেই আমরা বলতে পারব, চিকিৎসায় কোনো ত্রুটি ছিল কিনা।"
তদন্ত প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়া বা খৎনার অপারেশন করা চিকিৎসকরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করে যাবেন বলেও জানান আরিফুল ইসলাম।
তিনি বলেন, "কনসেন্ট (সম্মতি) ফরমসহ রোগীর প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্ট– আমরা রোগীর স্বজনদের দিয়েছি। এ বিষয়টি আমরা মানবিক দিক থেকে দেখেছি, তদন্ত কমিটি করেছি, আর্থিক বিষয়টিও দেখেছি মানবিকভাবে। তারা যদি আইনি কোন পদক্ষেপ নেন– তাহলে আমরাও আইন অনুযায়ী যা করার তাই করব।"
ইউনাইটেড হাসপাতালের মত ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজও ইউনাইটেড হেলথ কেয়ারের একটি প্রতিষ্ঠান উল্লেখ করে আরিফুল হক বলেন, আমরা জেসিআই এক্রিডেটেশন পাওয়া হাসপাতাল। সব ধরণের স্ট্যান্ডার্ড মেনে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা দেই আমরা। আমাদের চিকিৎসকদের মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই্। ইউনাইটেড হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্সদের ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজে এবং সেখানকার ডাক্তার-নার্সদের হাসপাতালে এক্সচেঞ্জ করা হয়।
ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ডা. আবদুল ওয়াকিল টিবিএসকে বলেন, "কোনো চিকিৎসক তো রোগীকে মেরে ফেলতে চাইবে না। অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যু হতে পারে। প্নেন অ্যাক্সিডেন্টে মানুষ মারা যায় না! আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসকদের কোন ভুল ছিল কিনা– তা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির রিপোর্ট পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অবশ্য ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসা, বা চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ নতুন কিছু নয়। এর আগে ২০১৫ সালে চিত্রনায়ক মান্নার মৃত্যু এবং ২০২২ সালের ১৪ ডিসেম্বর গালফ এয়ারের পাইলট ক্যাপ্টেন মোহান্নাদ ইউসুফ আলহেন্দির মৃত্যুর ঘটনায় ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ উঠেছিল।
এছাড়া ২০২০ সালের মে মাসে ইউনাইটেড হাসপাতালের কোভিড আইশোলেশন সেন্টারে আগুন লেগে ৫ জন রোগী মারা যায়; সে সময়ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গাফিলতির প্রমাণ পেয়েছিল তদন্ত কমিটি।