প্রতি ৫টির মধ্যে ২টি শিশুর জন্ম সিজারিয়ান ডেলিভারিতে
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি পাঁচটির মধ্যে দুটি শিশুর জন্ম হয় সি-সেকশনের (সিজারিয়ান ডেলিভারি) মাধ্যমে।
২০২২ সালে বাংলাদেশে সিজারিয়ান ডেলিভারির মাধ্যমে জন্ম নিয়েছে ৪১.৩৭ শতাংশ শিশু, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুপারিশকৃত হারের তুলনায় ২৭ শতাংশ বেশি। ডব্লিউএইচওর সুপারিশকৃত হার ১০-১৫ শতাংশ।
বিবিএসের বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক্স ২০২২ অনুসারে, খুলনা বিভাগে সিজারিয়ান ডেলিভারির হার সবচেয়ে বেশি। বিভাগটিতে ৫৭.৮৫ শতাংশ শিশুর জন্ম হয় সি-সেকশনের মাধ্যমে। সিজারিয়ান ডেলিভারির হার সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে—বিভাগটিতে ২৬.১৭ শতাংশ শিশুর জন্ম হয় সি-সেকশনের মাধ্যমে।
অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান ডেলিভারি বাড়ার পাশাপাশি দেশে শিশুমৃত্যুর হার বেড়েছে বলেও উঠে এসেছে বিবিএসের জরিপে। তবে দেশে মাতৃমৃত্যুর হার আগের তুলনায় কমেছে।
বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশিরভাগ পরিস্থিতিতে যোনিপথে বা স্বাভাবিক জন্ম হলো সবচেয়ে আদর্শ এবং সবচেয়ে বেশি উপযোগী জন্ম পদ্ধতি, যেখানে সি-সেকশন এমন পরিস্থিতিতে সুপারিশ করা হয় যখন স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব হয় না অথবা প্রসূতি বা নবজাতকের স্বাস্থ্য বিপন্ন হবার আশঙ্কা থাকে
বিবিএসের তথ্যানুসারে, পল্লি এলাকার তুলনায় সিটি কর্পোরেশন এলাকায় সি-সেকশনের প্রবণতা উদ্বেগজনক পরিস্থিতি হিসেবে পরিলক্ষিত হয়েছে। সিটি কর্পোরেশন এলাকায় প্রতি পাঁচটির মধ্যে প্রায় তিনটি জন্ম (৫৮.২১ শতাংশ) হয়েছে সি-সেকশনের মাধ্যমে। আর পৌরসভা ও অন্যান্য শহরাঞ্চলে এ হার ৫১ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন হার পল্লি এলাকায়, ৩৮.৪৬ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান ডেলিভারির কারণে মায়েদের শারিরীক ও আর্থিক ক্ষতি বাড়ছে। অপ্রয়োজনীয় সি-সেকশনে কমাতে মিডওয়াইফের সংখ্যা বাড়ানো, অ্যান্টিনেটাল কেয়ারের হার বাড়ানো এবং অপ্রোজনীয় সিজারিয়ান ডেলিভারি বন্ধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নীতিমালা বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন তারা।
দীর্ঘদিন ধরে সি-সেকশন ডেলিভারির বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করছেন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত জনস্বাস্থ্যবিদ ড. ইশতিয়াক মান্নান। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সিজারিয়ান সেকশন একটি জীবন রক্ষাকারী পদ্ধতি, এটি করা হয় মায়ের জীবন বাঁচানোর জন্য, যা মূলত ১৫ শতাংশ মায়ের জন্য।
তিনি বলেন, 'বেসরকারি হাসপাতালে নরমাল ডেলিভারির হার নগণ্য। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাজ হচ্ছে মান নিয়ন্ত্রণ করা। যাকে সিজার করার দরকার নেই, তাকে সিজার করা হচ্ছে—এটি বিরাট একটি অপরাধ; কারণ একজন মানুষের শরীরে অপ্রয়োজনীয় সিজার করা হলে অনেক জটিলতা ও আর্থিক ক্ষতি হয়। অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান ডেলিভারি রোধে করা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নীতিমালায় মিডওয়াইফ তৈরির কথা থাকলেও বাস্তবে তার বাস্তবায়ন নেই।'
বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে ৮৫ শতাংশ ডেলিভারি হয় সি-সেকশনে
বিবিএসের তথ্য বলছে, সি-সেকশনের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হওয়া মোট ডেলিভারির ৮৪.৮৬ শতাংশই সি-সেকশন।
অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকলজিক্যাল সোসাইটি অভ বাংলাদেশের সদস্য সাবেক প্রেসিডেন্ট ডা. ফেরদৌসি বেগম টিবিএসকে বলেন, 'বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নরমাল ডেলিভারি করাতে চাইলে আত্মবিশ্বাসী একটি টিম দরকার। একজন গাইনি বিশেষজ্ঞের পক্ষে ১০ ঘণ্টা একজন রোগীকে নিয়ে বসে থাকা সম্ভব নয়। ১০ ঘণ্টা মা ও বাচ্চাকে যন্তে রাখার জন্য প্রশিক্ষিত জনবল (জুনিয়র ডাক্তার, মিডওয়াইফ, নার্স) দরকার। এছাড়া বিভিন্ন আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন লাগবে, প্রপার লেবার রুম লাগবে।
'বেশিরভাগ প্রাইভেট ক্লিনিকে লেবার রুম নেই, টিম নেই। প্রত্যেকটা ক্লিনিকে যাতে লেবার রুম থাকে, টিম থাকে, তা তদারকি করতে হবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে।'
শিশুমৃত্যুর হার বেড়েছে
বর্তমানে দেশে প্রতি এক হাজারে জীবিত জন্ম নেওয়া ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ৩১ জন মারা যাচ্ছে। ২০১৯, ২০২০ ও ২০২১—টানা তিন বছর প্রতি হাজারে ২৮ শিশু মারা যেত।
পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুর মৃত্যুর জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী নিউমোনিয়া। এ বয়সে মৃত্যুবরণকারী শিশুদের প্রায় ২৯.৬৩ শতাংশই নিউমোনিয়ায় মৃত্যুবরণ করে। অন্য কারণসমূহের মধ্যে শ্বাসতন্ত্রের অসুস্থতায় ৭.৫৪ শতাংশ, জন্ডিসে ২.৮৭ শতাংশ এবং সাধারণ জ্বরে ৮.৩৮ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হয়।
পল্লি অঞ্চলে এ বয়সি শিশুর মৃত্যুর ৭.২৫ শতাংশ সংঘটিত হয় পানিতে ডুবে। শহরাঞ্চলে এ বয়সি শিশুর পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণের হার গ্রামের তুলনায় কম, মোট মৃত্যুর ৪.৮২ শতাংশ। পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম দুটি কারণ হচ্ছে শ্বাসকষ্টজনিত রোগ ও অপুষ্টি। এ বয়সি শিশুদের মোট মৃত্যুর ঘটনার ২.৮৩ শতাংশ সংঘটিত হয় হৃদরোগের কারণে।
মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে
মাতৃমৃত্যুর অনুপাত ২০২১ সালের তুলনায় (প্রতি লাখ জীবিত জন্মের বিপরীতে ১৬৮ জন) ২০২২ সালে এসে কমেছে (প্রতি এক লাখ জীবিত জন্মের বিপরীতে ১৫৩ জন)।
২০২২ সালে সামগ্রিকভাবে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি সন্তান প্রসবকারী প্রসূতিদের মধ্যে ৩৪.৩৪ শতাংশ তাদের প্রসবপূর্ব পরিচর্যার জন্য আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর নিকট কমপক্ষে চারবার পরিদর্শন করেছেন। সিটি কর্পোরেশন এলাকায় প্রসবপূর্ব পরিচর্যা গ্রহণ সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে (৬৫.৭১ শতাংশ)। এর পরের অবস্থান পৌরসভা এবং অন্যান্য শহরাঞ্চলের (৪৮.৭৯ শতাংশ)। পল্লি এলাকার মায়েদের মধ্যে জাতীয় গড় থেকে এ হার উল্লেখযোগ্যভাবে কম (২৮.৯০ শতাংশ)।