প্রজননে সহায়তায় সুন্দরবনে নির্মিত হচ্ছে বাঘের টিলা
প্রজনন পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে বিপন্নের ঝুঁকিতে থাকা সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা বাড়াতে সেখানে ১২টি কৃত্রিম টিলা তৈরি করছে বন কর্তৃপক্ষ।
বাঘ সাধারণত উঁচু স্থানে থাকতে পছন্দ করে। আর প্রজনন মৌসুমে তারা সবসময় উঁচু স্থান বেছে নেয়। বর্ষার মৌসুমে ভরা জোয়ার বা জলোচ্ছ্বাসের সময় যখন পানির উচ্চতা বাড়ে, তখন এই ম্যানগ্রোভ বনটির প্রাণীরা ভেসে যায়।
সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় এসব টিলা নির্মাণ করা হচ্ছে। এগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে 'বাঘের টিলা'। এগুলো শুধু বাঘকেই ভেসে যাওয়া থেকে সুরক্ষা দেবে না, বরং বাঘ যেসব প্রাণী খেয়ে থাকে, তেমন ছয়টি প্রাণীকেও সুরক্ষা দেবে।
পাশাপাশি প্রতিটি টিলার পাশে একটি করে মিঠাপানির পুকুরও খনন করা হচ্ছে, যাতে সেখান থেকে বন্য প্রাণীরা পানি পান করতে পারে।
বন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নির্মাণকাজ শেষ হলে টিলাগুলো বাঘের প্রজননে একটি আদর্শ জায়গা হবে এবং এটি বাঘের বংশ বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পর মা বাঘ কখনোই শাবকদের একা রেখে কোথাও যেতে চায় না। টিলার পাশে মিঠাপানির পুকুর থাকায় পানির বাঘের অনেক দূরে যেতে হবে না। বাঘ ছাড়াও প্রাণীটির খাবার যেমন চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণ, বন্য শূকর, বানর, সজারু ও গুইসাপের বসবাসে সহায়ক হবে এসব টিলা।
বন বিভাগের মতে, সুন্দরবনে যেসব জায়গায় বাঘের আনাগোনা বেশি, সেসব জায়গায় এসব টিলা নির্মাণ করা হচ্ছে।
জায়গাগুলো হলো- সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের নীল কমল, পাটকোস্ট, ভোমরখালী, পুস্পাকাটি, মান্দারাড়িয়া ও নোটাবেকী এলাকায় এসব টিলা নির্মাণ করা হচ্ছে। সেইসঙ্গে পূর্ব বন বিভাগের চাদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জের কটকা, কচিখালি, কোকিলমুনি, সুপতি, টিয়ারচর ও দুধমুখি অংশও টিলা নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় যুক্ত হচ্ছে।
২০২২ সালের ২৩ মার্চ সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পটির অনুমোদন দেয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। এর ব্যয় ধরা হয় আনুমানিক ৩৬ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের আওতায় ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে বাঘ, তাদের খাবার হিসেবে বিবেচিত প্রাণী ও খাল জরিপ করার মতো আরও কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।
বন বিভাগের তথ্যমতে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে মোট ৯ বার সুন্দরবনের বাঘ জরিপ করা হয়েছে। তবে ২০১৫ সালের আগের জরিপগুলোর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মো. ওয়াসিউল ইসলাম বলেন, 'যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, তাই উচ্চ জোয়ারের সময় বন্যপ্রাণীদের ভেসে যাওয়া সম্ভাবনা থাকে। এসব উঁচু টিলার কারণে বন্যপ্রাণীরা উপকৃত হবে।'
তিনি বলেন, 'এসব টিলা নির্মাণের ফলে যেন ইকোসিস্টেমের কোনো ক্ষতি না হয়, সেদিকে বন বিভাগের নজর রাখতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ১২টি টিলা নির্মাণ না করে, প্রাথমিকভাবে দুয়েকটি টিলা নির্মাণ করা উচিত ছিল। সেটি পর্যবেক্ষণ করে গবেষণার মাধ্যমে জানা দরকার ছিল এটি উপকার করবে কি না। যদি উপকারে আসত, তাহলে বেশি করে টিলা নির্মাণ করা উচিত ছিল।'
প্রকল্প পরিচালক ও সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন মতে, কয়েক বছর ধরে এই ম্যানগ্রোভ বনে বাঘের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে কমছে। ২০০৪ সালে পায়ের ছাপ পরিমাপের মাধ্যমে বন বিভাগের জরিপে বলা হয়, সুন্দরবনে বাঘ রয়েছে ৪৪০টি। ২০১৫ সালে সুন্দরবনে প্রথম ক্যামেরা ট্র্যাপ পদ্ধতিতে বাঘ জরিপ করা হয়। এতে বাঘের সংখ্যা বলা হয় ১০৬টি। ২০১৮ সালে একই পদ্ধতিতে জরিপে দেখা যায়, বাঘের সংখ্যা ১১৪টি। যা ২০১৮ সালের সংখ্যার চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি।
ড. আবু নাসের বলেন, 'আমরা জরিপের জন্য যেসব ক্যামেরা লাগিয়েছিলাম সেগুলোর ৫৫ শতাংশেই বাঘের ছবি পাওয়া গেছে। বনে বাঘের খাদ্য প্রাণীগুলোর সংখ্যাও বেড়েছে। তাই ধারণ করা হচ্ছে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে।'
তিনি যোগ করেন, বর্তমানে একটি জরিপ চলমান রয়েছে। সেটির ভিত্তিতে চলতি বছরের জুলাই মাসে দেশে বাঘের সংখ্যা জানা যাবে।
২০২৩ সালের জুলাই মাসে 'বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘ শিকারের প্রজাতির অবস্থা' শিরোনামে প্রকাশিত এক গবেষণায় সুন্দরবনের বাঘের খাবারের চিত্র উঠে এসেছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, সুন্দরবনে বাঘের ছয়টি শিকার প্রাণী রয়েছে। সেগুলো হলো- চিত্রা হরিণ ও বন্য শূকর, মায়া হরিণ, গুইসাপ, বানর ও শজারু। এর মধ্যে বাঘের মোট খাদ্যের ৭৯ শতাংশ চিত্রা হরিণ থেকে, ১১ শতাংশ বন্য শূকর থেকে এবং বাকি ১০ শতাংশ চারটি প্রাণী থেকে আসে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম এ আজিজের তত্ত্বাবধানে গবেষণাটি সম্পন্ন হয়।
গবেষণায় উঠে এসেছে, সুন্দরবনে চিত্রা হরিণ রয়েছে প্রায় এক লাখ ৪৭ হাজার ৩৫৭টি। এছাড়া বন্য শূকর রয়েছে ৪৫ হাজার ১১০টি, মায়া হরিণ রয়েছে ৬৮৭টি, গুইসাপ রয়েছে প্রায় ২৫ হাজার, বানর রয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার ৪৪৪টি ও শজারু রয়েছে ১২ হাজার ২৪১টি ।
অধ্যাপক এম এ আজিজ বলেন, 'বাঘ সংরক্ষণ করতে হলে, বাঘের শিকার প্রাণী রক্ষায় জোর দিতে হবে। আশার কথা হলো দেরিতে হলেও শিকার প্রাণীর সংখ্যা বেড়েছে। বৃদ্ধির এই হার বজায় থাকলে বাঘের সংখ্যাও বাড়বে।'