রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, গুরুত্বহীন, অপ্রয়োজনীয়: বাতিল হচ্ছে ৫ হাজার কোটি টাকার একাধিক প্রকল্প
২০১৯ সালে ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়নের প্রধান সড়ক প্রশস্তকরণ ও সংস্কারের জন্য ২,৬৩৭ কোটি টাকার একটি প্রকল্প শুরু করা হয়েছিল।
তবে, এ প্রকল্প চলমান থাকার পরও কেরানীগঞ্জ উপজেলায় রাস্তা উন্নয়নের জন্য আরেকটি প্রকল্প গ্রহণ করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। অথচ কেরানীগঞ্জ এলাকাটি আগের প্রকল্পের আওতায় ছিল।
১,০৯০ কোটি টাকার এ নতুন প্রকল্পের অর্ধেকের বেশি অর্থ ভূমি অধিগ্রহণের জন্য বরাদ্দ করা হয়। তবে অনুমিত বাজেটের তুলনায় এ খরচ অনেক বেশি করা হয়েছে বলে জানা যায়।
এলজিইডির এক কর্মকর্তা জানান, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর চাপে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল।
আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে এমন প্রকল্প গ্রহণ একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এলজিইডি এবং পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, তারা প্রায়ই রাজনৈতিক চাপের কারণে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হাতে নিতে বাধ্য হতেন।
বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ৫,০৬৭ কোটি টাকার বাজেটের ১০টি চলমান প্রকল্প বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের মতে, এসব প্রকল্পের বেশিরভাগই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা হয়েছিল এবং এগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ, বা অপ্রয়োজনীয়।
এছাড়া, আগের সরকারের সময় নেওয়া একই বিভাগের আওতাধীন ৩৭২টি চলমান প্রকল্পের মধ্যে ৬৭টি প্রকল্পের অপ্রয়োজনীয় স্কিম বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রকল্প বাস্তবায়নের কার্যকারিতা বাড়াতে প্রকল্পকে উচ্চ, মাঝারি ও নিম্ন অগ্রাধিকার তালিকায় ভাগ করা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ৩১ অক্টোবর এবং ৬ নভেম্বর কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা আরও জানান, বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্ত ও অগ্রাধিকার তালিকা ইতোমধ্যে পরিকল্পনা উপদেষ্টার কাছে পাঠানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে বলে জানান তিনি। 'প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে আনুষ্ঠানিকভাবে এসব স্কিম বা প্রকল্প বাতিল করা হবে।'
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ দায়িত্ব নেওয়ার পর বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থে অনেক প্রকল্প বা স্কিম নেওয়া হয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, প্রকল্প নির্বাচনে ঠিকাদারদের প্রভাব ছিল। এ ধরনের প্রকল্প চিহ্নিত করতে চলমান প্রকল্পগুলো পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের শ্বেতপত্র কমিটির খসড়া প্রতিবেদনে এ ধরনের প্রকল্পের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং শ্বেতপত্র কমিটির সদস্য জাহিদ হোসেন বলেন, যেসব প্রকল্প কৃষকদের পণ্য বাজারে আনা বা শিশুদের স্কুলে যাওয়া সহজ করার মতো আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখবে, সেগুলো বন্ধ করা উচিত নয়। তবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের সুবিধার্থে নেওয়া প্রকল্প বন্ধ করা উচিত।
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা কে মুজেরি বলেন, অপ্রয়োজনীয় এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত প্রকল্পগুলোর দ্রুত পর্যালোচনা সম্পন্ন করা জরুরি।
'অন্যথায় সরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে যাবে, যার ফলে বেসরকারি বিনিয়োগও কমবে এবং তা কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সরাসরি প্রভাব ফেলবে,' বলেন তিনি।
৫ হাজার কোটি টাকার ১০ প্রকল্প
বাতিলের প্রস্তাব পাওয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে ৩৪৯ কোটি টাকার হাওর ফ্লাইওভার ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প। এ প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ২৬টি প্যাকেজের মধ্যে মাত্র একটি সম্পন্ন হয়েছে।
এর দুটি প্যাকেজ অনুমোদন পেয়েছে, আটটির কাজের আদেশ জারি হয়েছে, এবং নয়টি এখনও অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। পরিবেশগত প্রভাব পুনর্মূল্যায়ন না হওয়া পর্যন্ত প্রকল্পটি স্থগিত রাখতে হবে।
প্রকল্প পরিচালক গোলাম মাওলা জানান, মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে প্রকল্পটি পরিদর্শন করেছে এবং কিছু সমস্যাযুক্ত স্কিম চিহ্নিত করে সেগুলো বাদ দিয়ে প্রকল্পটি চালিয়ে যাওয়ার সুপারিশ করেছে।
বারহাট্টা উপজেলায় ২৬ কোটি টাকার শিশু পার্ক নির্মাণ প্রকল্প এবং ফরিদগঞ্জের ১০৭ কোটি টাকার ডাকাতিয়া নদী সেতু প্রকল্প জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত সমস্যার কারণে বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
তবে ডাকাতিয়া নদী সেতু প্রকল্পের পরিচালক ইবাদত আলী বলেন, এ সেতুটি গাজীগঞ্জ ও ফরিদগঞ্জকে সংযুক্ত করবে এবং এটি একটি বড় বাজারের কাছে অবস্থিত। পরিকল্পনা কমিশনের মতামতের পর স্থানীয় সরকার বিভাগ প্রকল্পটি পরিদর্শন করেছে এবং এটি চালিয়ে যাওয়ার সুপারিশ করেছে।
তিনি আরও বলেন, প্রকল্পটির জন্য ইতোমধ্যে ১৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। অদক্ষ ঠিকাদারের কারণে ১.৫ বছর ধরে কাজ বন্ধ ছিল এবং একটি মামলাও দায়ের করা হয়।
তিনি বলেন, 'এখন আদালতের অনুকূল রায় পাওয়ার পর প্রকল্পটি শেষ করার জন্য শিগগিরই একটি নতুন দরপত্র আহ্বান করা হবে।'
একইভাবে, সুনামগঞ্জের মহসিন নদীর ওপর ৫০ কোটি টাকা বাজেটের পাগলা সেতু প্রকল্পটিও ব্যয়-সুবিধার অনুপাত পুনর্মূল্যায়নের জন্য পর্যালোচনাধীন রয়েছে।
মেহেরপুরে আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের জন্য ২১০ কোটি টাকার বাজেট নির্ধারিত হলেও এটি স্থগিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। কারণ, যশোরে ইতোমধ্যেই একটি অনুরূপ গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন এখনো শুরু হয়নি।
এছাড়াও, ৪৫৪.৮৩ কোটি টাকা বাজেটের বঙ্গবন্ধু-পিয়েরে ইলিয়ট ট্রুডো কৃষি প্রযুক্তি কেন্দ্র প্রকল্পটি বাতিলের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কারণ অন্যান্য সরকারি উদ্যোগে ইতোমধ্যেই অনুরূপ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু রয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকল্পের প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্বের অভাব উল্লেখ করে পরিকল্পনা কমিশন ১,৯০৩.৫৩ কোটি টাকার মুজিব কিল্লা নির্মাণ, মেরামত এবং উন্নয়ন প্রকল্প বাতিলের প্রস্তাব করেছে।
তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মো. আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেন, 'মুজিব কিল্লা প্রকল্পে ইতোমধ্যে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।'
তিনি প্রকল্পটি বন্ধ করার আগে চলমান নির্মাণ কাজ শেষ করার পরামর্শ দেন এবং পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে একটি চিঠি পাঠানোর পরিকল্পনার কথা জানান।
এছাড়াও, যশোরে শেখ জহুরুল হক পল্লী উন্নয়ন একাডেমির জন্য ১৯৮.৯৫ কোটি টাকার বাজেটের প্রকল্পটি অগ্রগতির অভাবে বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে।
অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা এবং বৈদেশিক রিজার্ভের ওপর চাপের কারণে মহাদেবপুর (নওগাঁ) সাইলো নির্মাণ প্রকল্প (৩৬৭.৫২ কোটি টাকা) এবং মডার্ন রাইস সাইলো নির্মাণ প্রকল্প (১,৪০০ কোটি টাকা) বাতিল করা হয়েছে।
কমিশনের পর্যালোচনা
পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুসারে, এলজিইডির ৯৮টি চলমান প্রকল্পের মধ্যে ৫২টি প্রকল্প অপ্রয়োজনীয় হিসেবে বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
যেমন, পাবনা ও বগুড়ার গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের (দ্বিতীয় পর্যায়) জন্য নতুন দরপত্র না দিয়ে বিদ্যমান কাজগুলো সম্পন্ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সময়মতো প্রকল্প শেষ করতে স্কিমগুলো পর্যালোচনা করে প্রাসঙ্গিক প্রকল্পগুলো অগ্রাধিকার দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাইন ব্রিজ কনস্ট্রাকশন প্রকল্পে যেসব ঠিকাদার কাজ করছে, তাদের বরাদ্দকৃত কাজ শেষ করতে হবে। তবে অনির্ধারিত প্যাকেজগুলো আপাতত স্থগিত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও, কুষ্টিয়া, গোপালগঞ্জ এবং অন্যান্য জেলায় গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে সময়মতো শেষ করতে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং চাঁদপুরের মতো জেলাগুলোতে প্রকল্প স্কিমগুলো সাইটে পর্যালোচনা করে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া নিশ্চিত করতে হবে।
পাশাপাশি, কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে সাতটি প্রকল্প, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অধীনে তিনটি করে প্রকল্প এবং মৎস্য অধিদপ্তর ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি করে প্রকল্প পুনর্মূল্যায়নের সুপারিশ করা হয়েছে।
২০৪ প্রকল্পকে উচ্চ-অগ্রাধিকার
পরিকল্পনা কমিশন কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের অধীনে ৩৭২টি প্রকল্পের জন্য অগ্রাধিকার তালিকা তৈরি করেছে। তবে বেশ কয়েকটি উচ্চ-অগ্রাধিকার প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় স্কিম থাকায় সেগুলোও বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এর মধ্যে ২০৪টি প্রকল্পকে উচ্চ-অগ্রাধিকার, ১১২টি প্রকল্পকে মাঝারি অগ্রাধিকার এবং ৫৫টি প্রকল্পকে নিম্ন অগ্রাধিকার হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা উল্লেখ করেছেন যে এ অগ্রাধিকার তালিকা গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে মনোযোগ দিতে সাহায্য করবে। একই সঙ্গে, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিম্ন-অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলো বাতিল করা বা তহবিল স্থগিত করাও সহজ হবে।