মাইনীমুখ বাজার: রাঙ্গামাটির কৃষি অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান কেন্দ্র
রাঙ্গামাটির পাহাড়ি এলাকার প্রত্যন্ত একটি গ্রামের বাসিন্দা কল্পনা চাকমা। নিজের জমিতে চাষ করা শিম, বেগুন আর বাঁধাকপি নিয়ে মাইনীমুখ বাজারে বিক্রি করতে এসেছেন তিনি। সবজি ও হাঁস-মুরগী বিক্রির টাকায় চলে তার সংসার।
কল্পনা চাকমার মতো হাজারো নারী-পুরুষ দেশের সীমান্তবর্তী রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলার মাইনীমুখ বাজারে আসেন তাদের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী বিক্রি করতে। শুধু সবজিই নয়, এই অঞ্চলের গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগী, ফল ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বৃহৎ বাজার এটি।
দুর্গম পাহাড়ি এলাকার প্রান্তিক চাষীরা এখানে নিয়ে আসেন তাদের উৎপাদিত ফসল। বেচা-কেনা শেষে আবার নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনে ফেরেন ঘরে। দুর্গম জনপদের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দু এই মাইনীমুখ বাজার।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এসব পণ্য কিনতে দেশের নানা প্রান্তের পাইকারি ব্যবসায়ীরা আসেন। প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত এসব পণ্যের কদরও তাই বেশি। সপ্তাহের প্রতি শনিবার বসা এই হাটে ২৫ হাজারেরও বেশি লোকের সমাগম হয়।
পঞ্চাশোর্ধ মনিকা চাকমা বলেন, 'এই বাজারের সঙ্গে আমাদের জীবন ও জীবিকার সম্পর্ক। কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের সবজি ও হাঁস-মুরগি বিক্রি করতে আসি। আজ (২৭ জানুয়ারি) এসেছি পাহাড়ি আলু বিক্রি করতে। এক সময় শুধু পাহাড়িরা এটি ক্রয় করলেও এখন এর চাহিদা বেড়েছে।'
বাজার কমিটির নেতারা জানান, এই বাজারে তিন শতাধিক স্থায়ী দোকান রয়েছে। প্রতি শনিবারে অস্থায়ী দোকান বসে আরো পাঁচ শতাধিক।
মাইনীমুখ বাজার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শাখাওয়াত হোসেন সোহেল বলেন, 'মাইনীমুখ বাজার হলো তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে সর্ববৃহৎ এবং প্রাচীন হাটগুলোর একটি। প্রতি শনিবার আড়াই থেকে তিন কোটি টাকার পণ্য কেনা-বেচা হয় এই হাটে।'
তিনি আরো বলেন, 'গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগী থেকে শুরু করে এখানকার এলাকার জনগণের উৎপাদিত শাক-সবজি পাইকারদের মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। প্রতি বাজারে প্রায় সাত শরও বেশি গরু ওঠে। ছাগলও ওঠে প্রায় একই পরিমাণ। কোরবানির সময় দেশি গরু-ছাগল যোগানের বড় মাধ্যম হয়ে ওঠে মাইনীমুখ বাজার।
স্থানীয় বাসিন্দা আবদুর রহিম বলেন, 'আমি তিনটি গরু নিয়ে এসেছি বিক্রি করতে। স্থানীয় ক্রেতার পাশাপাশি বিভিন্ন গরুর খামারি এবং ব্যাপারী আসায় দ্রুত গরুও বিক্রি হয়ে যায়।'
বৃষকেতু চাকমা বলেন, 'আমি জুম চাষের পাশাপাশি ছাগল পালন করি। আজ দুটি ছাগল এনেছি। পণ্য বিক্রি করে সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্য কিনি। এখানে কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই পণ্য বেচা-কেনা করা যায়।'
চট্টগ্রামের মুরগী ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, 'আমি মাইনীমুখ বাজার থেকে ২০০ কেজি দেশি মুরগি কিনেছি। লঞ্চযোগে এগুলো রাঙ্গামাটি হয়ে সড়ক পথে চট্টগ্রামের রেয়াজুদ্দিন বাজারে নিয়ে যাই। আমি নিয়মিত এই বাজার থেকে চট্টগ্রামে মুরগী সরবরাহ করি।'
মাইনীমুখ বাজার নৌপথে রাঙ্গামাটি এবং সড়ক পথে খাগড়াছড়ির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। তাই ব্যবসায়ীরা খুব সহজেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পণ্য নিয়ে যেতে পারেন। এছাড়া নৌপথে দীঘিনালা ও বাঘাইছড়িসহ আশপাশের কয়েকটি উপজেলার লোকজন নৌকা নিয়ে সহজেই বাজারটিতে যাতায়াত করতে পারেন।
নরসিংদীর বাবুরহাট এলাকার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শরীফ তিন বছর ধরে এ বাজারে যাতায়াত করছেন। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'তিন বছর থেকে আমি মাইনীমুখ বাজারে কাপড়ের ব্যবসা করি। বিভিন্ন দোকানে কাপড় সরবরাহ করি। দুর্গম এলাকা হলেও রাঙ্গামাটি এবং খাগড়াছড়ি এই দুই জেলার সঙ্গে যোগাযোগ ভালো হওয়ায় সহজেই এখানে পণ্য পাঠানো যায়।'
বাজারকে কেন্দ্র করে শুক্রবার থেকেই শুরু হয় প্রস্তুতি। শুক্রবার দুপুর থেকেই দেশের নানা অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা বাজারে আসতে শুরু করেন। থাকেন বাজারের বিভিন্ন হোটেল ও বোর্ডিংয়ে। তাই বাজারকে কেন্দ্র করে অন্যান্য ব্যবসাও জমজমাট হয়ে ওঠে। যা ক্রমবর্ধমান স্থানীয় অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।
সরেজমিন শুক্রবার (২৬ জানুয়ারি) বিকেলে দেখা যায়, নৌকায় করে বিক্রির জন্য বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী জড়ো করছেন ব্যবসায়ীরা। পণ্য ওঠানো ও নামানোয় লঞ্চঘাটে ব্যস্ত শত শত শ্রমিক। রাত পর্যন্ত চলে নৌকা থেকে পণ্য নামানোর কাজ।
শনিবার সকালের মধ্যেই নৌকায় করে পণ্য নিয়ে বাজারে হাজির হন আশে-পাশের নারী ও পুরুষরা। কেউ সবজি, কেউ হাঁস-মুরগি, কেউ আনেন গবাদি পশু। সকাল ১০টা থেকেই ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতিতে পুরো বাজার ভরে ওঠে।
বিকেল থেকে শুরু হয় পাইকারি ব্যবসায়ীদের পণ্য নিয়ে যাওয়ার ব্যস্ততা। নৌকা, লঞ্চ, ট্রাক ও পিকআপে করে নির্দিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশে শুরু হয় পণ্য বোঝাই।