ফেব্রুয়ারিতেই আপনার বিদ্যুৎ বিল বাড়ছে সাড়ে ৮ শতাংশ
দুই দিন আগেই গ্যাসের দাম বাড়ায় সরকার, তারপর বৃহস্পতিবারে বিদ্যুতের দাম গড়ে সাড়ে ৮ শতাংশ বাড়িয়েছে।
বর্তমানে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি ইউনিটের দাম ৬ টাকা ৭০ পয়সা, যা ৭ টাকা ৪ পয়সা করা হয়েছে। আর খুচরায় ৮ টাকা ২৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা ৯৫ পয়সা করা হয়েছে। অর্থাৎ খুচরায় ভারিত গড়ে বাড়ল ৭০ পয়সা।
এর আগে মার্চ থেকে দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হলেও, গতকাল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ তা ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই কার্যকর করার কথা জানান। এসময় পরবর্তী মাসের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের সময় প্রিপেইড মিটারের গ্রাহকদের ফেব্রুয়ারি মাসের বর্ধিত বিল সমন্বয় করার কথা জানান তিনি।
বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুতের বাড়তি দাম মেটাতে ব্যক্তি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে তাদের বাজেটের আরো বড় অংশ ব্যয় করতে হবে। এতে মুদিপণ্য, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাসহ নানান অত্যাবশ্যকীয় চাহিদা মেটানোর মতো ব্যয়যোগ্য আয়ে আরো টান পড়বে; এতে ব্যবসাবাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কারণ তাদের মুনাফার পরিমাণ ও প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হ্রাস পাবে।
তারা সতর্ক করে বলেছে, বিদ্যুতের এই দর বাড়ানোর ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে। কারণ বিদ্যুৎ বিভিন্ন উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মৌলিক ইনপুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ব্যবসায়ীদের যেহেতু বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির বোঝা বহন করতে হবে– তাই শেষ পর্যন্ত তারাও দাম বাড়িয়ে এই ব্যয় গ্রাহকদের উপর চাপিয়ে দেবে। ফলে গৃহস্থালি থেকে সেচ পর্যন্ত অর্থনীতির সব খাতে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়তে পারে।
বাংলাদেশ এমন সময় দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যখন বিশ্বের অনেক দেশে পাইকারি বিদ্যুতের দাম কমেছে। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা– ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ)-র তথ্মতে, ২০২২ সালে রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছানোর পরে ২০২৩ সালে বিদ্যুতের দাম কমেছে, বিশেষত তা হয়েছে এশিয়া ও ইউরোপের দেশগুলোতে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. শামসুল আলম ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির মধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়ার বিরূপ প্রভাবের কথা তুলে ধরেন।
তাঁর মতে, "সরকারের বিদ্যুৎ খাতের নীতিগত বিভ্রান্তি কিছু কোম্পানিকে লুন্ঠনের সুযোগ করে দিয়েছে, যার ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিম্ন-আয়ের মানুষ।''
দেশের পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তাদের শীর্ষ সংগঠন– বিজিএমইএ'র সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, "এ সময়ে দাম বাড়ানো ঠিক হচ্ছে না। এতে ব্যবসায়ীদের উপর চাপের উপর চাপ তৈরি হচ্ছে, এবং আমাদের পণ্য উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। যার ফলে দেশজ পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ ইম্পোর্টেড (আমদানি করা) পণ্যের দিকে ঝুঁকবে। বিদেশি বায়াররাও বাংলাদেশে অর্ডার দিতে নিরুৎসাহিত হবে।"
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের চিত্র
বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিপিডিবি)-র তথ্যাসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ৯৮ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮৭ হাজার ২৪ মিলিয়ন (৮ হাজার ৭০২ কোটি) কিলোওয়াট ঘন্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে।
প্রতি ইউনিটের গড় উৎপাদন খরচ ১১ টাকা ৩৩ পয়সা; কিন্তু বিক্রি করা হচ্ছে ৬ টাকা ৭০ পয়সা দরে– এতে প্রতি ইউনিটেই লোকসান হচ্ছে প্রায় ৪ টাকা ৬৩ পয়সা। এই ভারসাম্যহীনতার কারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪৭ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এই লোকসানের কারণে বিদ্যুৎ ক্রয়ে সরকারকে বড় সমস্যার মধ্যে পড়তে হচ্ছে, কারণ বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের থেকে ৮২ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কিনতে হয় সরকারকে। অন্যদিকে, সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় ১৩ হাজার ৩০৭ টাকা মূল্যের বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়।
নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় বিপিডিবির প্রতি ইউনিটের উৎপাদন খরচ ৭ টাকা ৬৩ পয়সা, বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের (আইপিপি) ক্ষেত্রে তা ১৪ টাকা ৬২ পয়সা, ভাড়া-ভিত্তিক কেন্দ্রে ১২ টাকা ৫৩ পয়সা এবং পাবলিক প্লান্টে ৬ টাকা ৮৫ পয়সা এবং ভারত থেকে আমদানি করা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ ৮ টাকা ৭৭ পয়সা।
বেসরকারি খাত ও ভারত থেকে মার্কিন ডলার দিয়ে বিদ্যুৎ ক্রয় করে সরকার।
১৪ বছরে বেড়েছে ১৩০ শতাংশ
বিপিডিবির তথ্যমতে, গত ১৪ বছরে ১৩ দফায় খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে প্রায় ১৩০ শতাংশ।
২০০৯ সালে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট, দাম ছিল ইউনিটে ৩ টাকা ৭৩ পয়সা। বর্তমানে সক্ষমতা ২৯ হাজার ১৭৪ মেগাওয়াট, আর দামও বেড়ে হয়েছে ৮ টাকা ৯৫ পয়সা।
সবশেষ এর আগে ২০২৩ সালের মার্চে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করা হয়, তখন ভারিত গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ টাকা ২৪ পয়সা করা হয়।
বিশ্ববাজারে কমলেও দেশে জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়নি
২০২২ সালের আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাড়ানো হয়। ব্যাপক সমালোচনার মুখে ওই মাসে মাত্র ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ দাম কমানো হয়েছিল। বর্তমানে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিন ১০৯ টাকা, পেট্রল ১২৫ টাকা এবং অকটেন বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকা।
গত বছর জ্বালানি তেলের দাম কমে ৭০ ডলারের নিচে নেমে আসে বিশ্ববাজারে। বর্তমানে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ৮০ ডলার। আর ডিজেলের দাম ৯৮ ডলারের কাছাকাছি। এছাড়াও, বর্তমানে বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। প্রতি এমএমবিটিইউ (মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট) এলএনজির দাম গত বছর যেখানে ১৮ ডলার ও ২০২২ সালে ৩২ ডলার ছিল– তা বর্তমানে ৯ ডলারে রয়েছে।
বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয়ের কথা বলে দেড় বছর আগে বাড়ানো হয় জ্বালানি তেলের দাম। তখন বলা হয়েছিল, বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশেও কমবে। তবে সেটি আর হয়নি। এতে গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া বাড়তি দরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)-র মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা মুনাফা করলেও– ভোক্তাদের ওপর চাপ বেড়েছে বলে মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন বলেন, সরকার আইএমএফের কথামতো বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে, অথচ আইএমএফের কথামতো তো এলএনজি-ডিজেলসহ অন্যান্য জ্বালানির দাম কমাচ্ছে না। দেশের বাজারে বর্তমান দাম আন্তর্জাতিক দামের চেয়ে অনেক বেশি। সরকারের এ ধরনের দ্বৈত নীতির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিম্ন-আয়ের মানুষ।
ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা
অধ্যাপক ইজাজ হোসেন আরো বলেন, বিশেষ করে ক্যাপাসিটি চার্জ-সংক্রান্ত অব্যবস্থাপনার কারণে সরকার বিদ্যুতে বিপুল ভর্তুকি দিতে বাধ্য হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ খাতে অদক্ষতা তৈরি হয়েছে।
এ খাতের চ্যালেঞ্জগুলোর দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে ক্যাপাসিটি চার্জ চুক্তি বাতিল করে প্রতিযোগিতামূলক সমন্বিত বিদ্যুতের বাজার তৈরি করার পরামর্শ দেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর সাবেক এই অধ্যাপক।
একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু বা কমিশনিং হওয়ার পর– সেটি বিদ্যুৎ উৎপাদন করুক বা না করুক– ওই কেন্দ্রকে চার্জ দিতে হয় সরকারের – সেটিই ক্যাপাসিটি চার্জ।
বিপিডিবির তথ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে সূত্রমতে, ২০২২-২৩ সালে বিদ্যুৎ খাতে সরকার ৪৩ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ করেছিল, যার বড় একটি অংশ– ১৭ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের অনেক সুবিধা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে রয়েছে স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতার অভাব।
এছাড়া দেশে গ্যাস উত্তোলনের চেয়ে আমদানির দিকে বেশি নজর দেওয়া হয়েছে। ফলে এ সমস্যা দীর্ঘমেয়াদি। স্বল্পমেয়াদে এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে হলে– মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার ওপর জোর দিতে হবে। এছাড়াও, বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিগুলো নিয়ে পুনরায় আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া উচিত"- তিনি যোগ করেন।
লোডশেডিং চলবে
শীতের মৌসুম না কাটতেই– রাজধানীসহ সারাদেশে আবারও লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষত, গ্রামাঞ্চলে তা বেশি হচ্ছে।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)-র তথ্যানুযায়ী, গত ২১ জানুয়ারির পর থেকে দুইদিন অন্তর লোডশেডিং করতে হয়েছে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোকে। আর ফেব্রুয়ারি মাসে লোডশেডিং হয়েছে প্রতিদিনই।
সাম্প্রতিক সময়ে দৈনিক সর্বনিম্ন ৫০ শুরু করে সর্বোচ্চ ৬৫০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হয়েছে।
এবারের গ্রীষ্মকালে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে প্রায় ১৭ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট হবে এমন ধারণা করছে বিপিডিপি।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ– পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন টিবিএসকে বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগ যেভাবে পরিকল্পনা করছে, তাতে এবছর ১৬ হাজার মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদন করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। কিন্তু এবছর চাহিদাও বাড়বে, ফলে লোডশেডিং বন্ধ হবে না। বিশেষত যদি জ্বালানি আমদানিতে ব্যাঘাত ঘটে এবং বিশ্ববাজারে জ্বালানি মূল্যে নতুন কোনো সংকট তৈরি হয়– সেক্ষেত্রে ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ১,৫০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।