কুমিল্লা সিটি উপনির্বাচন: সংঘর্ষ-গুলি, আহত ২, দক্ষিণে ভালো ভোট
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরু হয় শনিবার সকাল ৮টায়। চলে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। ইভিএম পদ্ধতিতে এবারের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনকে ঘিরে বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে দুই পক্ষের সংঘর্ষ ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে।
এছাড়াও বিভিন্ন প্রার্থীর এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার মতো অভিযোগও পাওয়া গেছে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। এদিকে সংঘর্ষের ঘটনায় একজনকে আটক করেছে পুলিশ।
সরেজমিনে নগরীরর বিভিন্ন এলাকায় ভোটকেন্দ্রগুলোতে দেখা যায়, সকালে ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার পর কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি ছিল তুলনামূলক কম। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটার উপস্থিতিও বাড়তে থাকে।
এদিকে কেন্দ্রের বাইরে মোড়ে মোড়ে সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহারের মেয়ে ও বাস প্রতীকের প্রার্থী তাহসিন বাহার সূচনার কর্মী-সমর্থকদের উপস্থিতি চোখে পড়ে।
এদিন সকাল ৮টায় রিয়াজ উদ্দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দেখা যায়, স্ট্রাইকিং ফোর্সসহ প্রায় ৩০ জন পুলিশ ও আনসার সদস্য কেন্দ্র পাহারা দিচ্ছেন। এরই কিছুক্ষণ আগে কেন্দ্রটির সামনে দুই পক্ষের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এমনকি বাস প্রতীকের কর্মী-সমর্থকরা কেন্দ্র থেকে টেবিল ঘড়ি, ঘোড়া ও হাতির এজেন্টদের বের করে দেন বলেও অভিযোগ ওঠে।
নগরীর কাপ্তান বাজার ও ইসলামিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্রলীগ কর্মীদের দেখা যায়। তারা এমপি বাহারের অনুসারী।
বাগিচাগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র সংলগ্ন ভূতের গলি, অশোকতলা, মালেকা মমতাজ উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র, ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ এবং কুমিল্লা হাইস্কুল কেন্দ্রেও একই চিত্র চোখে পড়ে।
টেবিল ঘড়ি প্রতীকের প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু বলেন, '৫, ৬ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডে আমার ভোটার এবং এজেন্টদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ৫ নম্বর ওয়ার্ডে আমার এজেন্টদের মারধর করে বের করে দিয়েছেন বাস প্রতীকের লোকজন।'
ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার বলেন, '৩, ৫ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডে আমার ভোটার-এজেন্ট সবাইকে বের করে দিয়েছেন বাস প্রতীকের লোকজন। তারা নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করে ভোটারদের আটকানোর চেষ্টা করেছেন।'
হাতি প্রতীকের প্রার্থী নূর-উর রহমান মাহমুদ তানিম বলেন, 'ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শুরু থেকেই আমার এজেন্ট থেকে ফলাফল শিটে স্বাক্ষর নিয়ে রাখা হয়। বেশকিছু কেন্দ্রে আমার এজেন্টদের বের করে দিয়েছেন বাস প্রতীকের কর্মীরা।'
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে ভোটার উপস্থিতি
ভোটের শুরুর দিকে নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে ভোটারদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি বাড়তে দেখা যায়।
কুমিল্লা নগরীর কাপ্তানবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, দুপুর ১২টা পর্যন্ত ওই কেন্দ্রে ৪০ শতাংশ ভোট কাস্ট হয়। সেখানে মোট ভোটার তিন হাজার ৫৬ জন।
আসমা আক্তার নামে একজন ভোটার বলেন, 'ভোট দিয়েছি। কোনো ঝামেলা হয়নি। ভোট দিতে পেরে ভালো লাগছে।'
হালিমা বেগম নামে আরেক ভোটার বলেন, 'এখানে শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে। ভোটের পরিবেশ ছিল উৎসবমুখর।'
কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার জয়নাল আবেদিন বলেন, 'ইভিএমে কোনো সমস্যা হয়নি। ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিয়েছেন।'
এদিকে কুমিল্লার সদর দক্ষিণের নয়টি ওয়ার্ডের কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি ছিল বেশি।
কুমিল্লা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা কাজী আপন তিবরানী জানান, এ কেন্দ্রে ৪২ শতাংশের মতো ভোট পড়েছে। ভোটের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভোটের পরিবেশ চমৎকার ছিল।
সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ তিন, আটক এক
এদিকে কুমিল্লা নগরীর ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের একটি ভোটকেন্দ্রে বাস প্রতীকের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে ঘোড়া প্রতীকের কর্মী-সমর্থকদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে ঘোড়া প্রতীকের দুইজন গুলিবিদ্ধ হন বলে দাবি করেন ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার।
তবে তাহসিন বাহার সূচনা দাবি করেন, 'ঘোড়ার কর্মীরা গুলিবিদ্ধ হয়নি, বরং বাস প্রতীকের এক কর্মীকে গুলি করা হয়েছে। আমার কর্মীকে গুলি করে আমাদের ওপরেই দোষ চাপানো হচ্ছে।'
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শনিবার সকাল ১০টায় কুমিল্লা নগরীর ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের মুন্সি এম আলী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের পাশেই সংঘর্ষ চলাকালে ঘোড়া প্রতীকের সমর্থক জহিরুল আহমেদ ও তুহিন গুলিবিদ্ধ হন। পরে স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।
আহত জহির বলেন, 'ভোট ক্যাম্পের পাশে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। বাস মার্কার সমর্থক ও ১৫ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি সুজন আমাকে ও তুহিনকে পুলিশের সামনেই গুলি করে।'
ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার বলেন, 'বাস প্রতীকের প্রার্থী তাহসিন বাহার সূচনার সমর্থকরা ভোট দিতে আসতে দিচ্ছেন না। বিভিন্ন জায়গায় তারা আমার সমর্থকদের ওপর হামলা করেছে। ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের মুন্সি এম আলী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গুলিবিদ্ধ হয়েছে আমার কর্মীরা।'
তবে ছাত্রলীগ নেতা সুজন দাবি করেন, তাকে ঘোড়া প্রতীকের কর্মীরা গুলি করেছে। তিনি কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
এ বিষয়ে প্রিজাইডিং অফিসার হাসান আহমেদ কামরুল বলেন, 'ঘটনাটি ভোটকেন্দ্রের সীমানার বাইরে ঘটেছে। আমি বিষয়টি ম্যাজিস্ট্রেটকে জানিয়েছি।'
সদর দক্ষিণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর হোসেন ভূঁইয়া বলেন, 'গুলির ঘটনায় সন্দেহভাজন একজনকে আটক করা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।'
উপনির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ফরহাদ হোসেন বলেন, 'কুমিল্লায় বেশ ভালো ভোট হয়েছে। দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।'
কুমিল্লার আদর্শ সদর ও সদর দক্ষিণ উপজেলার ২৭টি ওয়ার্ড ও ১০৫টি কেন্দ্র নিয়ে এই সিটি করপোরেশন। এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন চার প্রার্থী। ঘড়ি প্রতীকে সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু, ঘোড়া প্রতীকে কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবকদলের সাবেক সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সার, বাস প্রতীকে মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাহসিন বাহার ও হাতি প্রতীকে মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা নূর-উর রহমান মাহমুদ তানিম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে দুই লাখ ৪২ হাজার ৪৫৮ জন ভোটার ছিলেন। পুরুষ ভোটার এক লাখ ১৮ হাজার ২৮২ জন, নারী ভোটার এক লাখ ২৪ হাজার ২৭৮ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার দুইজন।
২০২২ সালের কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের তৃতীয় নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন নৌকা প্রতীকের আরফানুল হক রিফাত। ২০২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।