দেশে মাত্র ২% রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন: সুযোগ-সুবিধা অপর্যাপ্ত, আছে আইনি বাধা
দেশে প্রতিবছর গড়ে ৩০-৪০ হাজার রোগীর কিডনি স্থায়ীভাবে ড্যামেজ বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়; আর যাদের ডায়ালাইসিস বা ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা ছাড়া উপায় থাকেনা, তাদের মধ্যে কেবল ১০ শতাংশ রোগী এই সুবিধা পান।
আইনি জটিলতা এবং অপর্যাপ্ত সুবিধার কারণে দেশে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট বা প্রতিস্থাপন হচ্ছে মাত্র ২ শতাংশ রোগীর। নিকটআত্মীয় ডোনার না পেয়ে বছরে প্রায় ১২০০-১৫০০ রোগী বিদেশে অবৈধ কাগজপত্র দেখিয়ে প্রায় দশগুণ বেশি টাকা ব্যয় করে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করছেন।
এতে একদিকে দেশের টাকা বিদেশে যাচ্ছে, অন্যদিকে ডোনারদের ফলোআপ ঠিকমত না হওয়ায় রোগীর চাপ আরও বাড়ছে। ঢাকার বাইরে ডায়ালাইসিস সুবিধাও পর্যাপ্ত নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষ কোনো না কোনো কিডনি রোগে ভুগছে। এরমধ্যে পার্মানেন্ট কিডনি ড্যামেজ হয় ৩০-৪০ লাখ রোগীর। দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ রোগী জানেন না তারা হাইপারটেনশন বা ডায়বেটিসে ভুগছেন। সাইলেন্ট কিলার ডায়বেটিস ও হাইপারটেনশন বাড়িয়ে দিচ্ছে কিডনি রোগীর সংখ্যা।
এমন পরিস্থিতিতে দেশে আজ বৃহস্পতিবার (১৪ মার্চ) পালিত হচ্ছে বিশ্ব কিডনি দিবস। এবারের কিডনি দিবসের প্রতিপাদ্য হলো 'কিডনি হেলথ ফর অল', অর্থাৎ, সবার জন্য সুস্থ কিডনি।
দেশে এখন বছরে ২৫০টি কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়। যদিও বছরে প্রায় ১০ হাজার ট্রান্সপ্ল্যান্টের প্রয়োজন বলে মনে করছেন কিডনি বিশেষজ্ঞরা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) রেনাল ট্রান্সপ্লান্ট বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল, "আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম ট্রান্সপ্ল্যান্ট হচ্ছে। এর পিছনে কারণ হলো দুইটা: একটি হলো– বিদ্যমান আইনে আত্মীয় ছাড়া কিডনি দেওয়ার নিয়ম নেই; কিন্তু যাদের আত্মীয় নেই তারা কিডনি পায়না। এছাড়া আমাদের যে সেন্টারগুলো আছে, সেগুলোতে এতো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার সক্ষমতা নেই। ট্রান্সপ্ল্যান্টের জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছেন বেশিরভাগ রোগী। যাদের আত্মীয় নেই তারা অবৈধ কাগজ বানিয়ে বিদেশে গিয়ে প্রায় ৫০ লাখ টাকা ব্যয় করে একটি কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করছেন।"
''বিদেশে যারা অবৈধ কাগজ তৈরি করে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করছেন, সেখানে খরচ বেশি হওয়ার পাশাপাশি আরেকটি সমস্যা হচ্ছে ডোনারদের ফলোআপ হচ্ছেনা। ডোনারদের ফলোআপ না করার কারণে তাদের যে একটি কিডনি থাকে তাও নষ্ট হয়ে যায়, ফলে রোগীর চাপ আরও বাড়ে," যোগ করেন ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল।
বাংলাদেশের আইনে ২২ ধরনের আত্মীয় থেকে কিডনি নেওয়া যাবে। মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন (সংশোধন) আইন–২০১৮ অনুযায়ী, জীবন রক্ষায় নিকটাত্মীয়ের কিডনি নেওয়া যাবে। নিকটাত্মীয় হচ্ছেন– মা, বাবা, ছেলে, মেয়ে, ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী ও আপন চাচা, ফুফু, মামা, খালা, নানা, নানি, দাদা, দাদি, নাতি, নাতনি এবং আপন চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো, খালাতো ভাই বা বোন– এর বাইরে কেউ কিডনি দিতে পারবেন না।
অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান বলেন, "আত্মীয় স্বজনের বাইরে কাছের মানুষ, বন্ধু ও ইমোশনাল ডোনাররা কিডনি দিতে আগ্রহী হয়ে থাকেন কোনো লেনদেন ছাড়া। তবে আইনের জটিলতায় এটি সম্ভব হচ্ছে না। মানুষজন দেশের বাইরে যাচ্ছে। দেশের টাকা বাইরে যাচ্ছে। আবার দালালদের দৌরাত্ম্যও কমে না। তাই আইনে 'ইমোশনাল ডোনার' বিষয়টিকে সংযুক্ত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি কঠোর মনিটরিং নিশ্চিত করতে হবে যাতে অবৈধ কিডনি বেচাকেনা না হয়।"
কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট সুবিধাও অপর্যাপ্ত
সরকারি পর্যায়ে শুধু ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ কিডনি ডিজিজ অ্যান্ড ইউরোলজি (এনিআইকেডিইউ) এবং বিএসএমএমইউতে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়। আর বেসরকারি পর্যায়ে কিডনি ফাউন্ডেশন, সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হসপিটাল বার্ডেম এবং এভারকেয়ার হাসপাতালে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়।
সরকারি পর্যায়ে এনআইকেডিইউতে বিনামূল্যে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়; রোগীদের এখানে শুধু ওষুধের খরচ দিতে হয়। আর বিএসএমএমইউতে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকার দুই সপ্তাহের প্যাকেজ, সুপার স্পেলাইজড হাসপাতালে ৩ লাখ টাকার প্যাকেজ চালু রয়েছে।
অন্যদিকে, বেসরকারি হাসপাতালে একেক জায়গায় একেক রকম। ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা খরচ হয় সেখানে। বিদেশে অনাত্মীয় রোগীদের প্রায় ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়।
বেশিরভাগ কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টারও ঢাকাকেন্দ্রীক। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে সীমিত পরিসরে কিডনি ডায়ালাইসিস শুরু হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। তবে নোয়াখালিতে ডায়ালাইসিস সেন্টার পর্যাপ্ত আছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
ক্যাডাভেরিক কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট বাড়লে সংকট কমবে
২০২৩ সালের ১৮ জানুয়ারি বিএসএমইউ এর আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ব্রেন ডেড পেশেন্ট সারা ইসলামের কিডনি দুজন রোগীর শরীরে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার মধ্য দিয়ে দেশে প্রথম ক্যাডাভেরিক কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়। এরপর চলতি বছরের জানুয়ারিতে ব্রেইন ডেড রোগী মো. মাসুম আলমের (৩৮) দুটি কিডনি দুজন কিডনি রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। দেশে ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্ল্যান্ট চালু হলেও এখনও মানুষের মধ্যে সেরকম সাড়া পাওয়া যাচ্ছেনা।
ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল বলেন, ব্রেন ডেড রোগীর কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টে মানুষকে আগ্রহী করা একটি দূরহ কাজ। মানুষকে এ বিষয়ে অনেক বোঝাতে হবে। যদি ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্ল্যান্ট পুরোদমে শুরু করা যায়, তাহলে অনেক কিডনি রোগী এই সুবিধা পাবেন, কিডনির সংকট কাটবে।
কিডনি ফাউন্ডেশন অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কিডনি প্রতিস্থাপনের ৩০ শতাংশ হয় জীবিত নিকটাত্মীয় থেকে এবং বাকি ৭০ শতাংশ হয় ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্ল্যান্টের মাধ্যমে।
"ইসলামী দেশগুলোতে বিশেষ করে সৌদি আরব, ইরান ও কুয়েতে ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হচ্ছে। আমাদের দেশেও মানুষকে এটি বোঝাতে হবে। এ রোগের জটিলতা ও চিকিৎসা ব্যয়ের আধিক্য বিবেচনায় প্রতিরোধকেই একমাত্র অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে হবে," যোগ করেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন, বলেন, এখন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অসংক্রামক বা নন-কমিউনিকেবল ডিজিস (এনসিডি) কর্নারে ডায়বেটিস ও হাইপারটেনশনের ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়।
"আগামী বছর থেকে আমরা সেখানে মাল্টিসটিক্স দেবো। এনসিডি কর্নারে এই স্টিক দিয়ে প্রোটিন লেভেল ও সুগার লেভেল টেস্ট করতে পারবে স্বাস্থ্যকর্মীরা, তাহলে শুরুতেই কিডনি রোগী শনাক্ত করা যাবে।"
"কিডনি রোগী বেড়ে যাওয়া আটটি বিভাগীয় শহরে ক্যান্সার হাসপাতালের সাথে কিডনি ইউনিটও স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এতে কিডনি সুবিধা বাড়বে," যোগ করেন অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন।