ডায়ালাইসিস সংকট: কিডনি রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় কীভাবে কমানো যায়?
২০১৩ সাল থেকে সপ্তাহে তিনদিন ডায়ালাইসিস নিতে হয় কিডনিরোগী মাসুদ রানাকে। প্রতি মাসে ডায়ালাইসিস নিতে তার খরচ হয় প্রায় ৩৫,০০০ টাকা।
একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন সেলসম্যান মাসুদ রানার পক্ষে এ ব্যয় বহন করা কঠিন। দীর্ঘদিন ধরে ডায়ালাইসিস করতে গিয়ে জমি বিক্রি করতে হয়েছে। এখন আত্মীয়, বন্ধু, সহকর্মীদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে ডায়ালাইসিস করতে হয় তাকে।
মাসুদ রানা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ঢাকা শহরে বাসা ভাড়া দিয়ে, ছেলে মেয়ের পড়াশুনার খরচ দিয়ে ডায়ালাইসিস চিকিৎসা করা কঠিন। আমি এখন অন্যের অনুদানে ডায়ালাইসিস করি, ধার করে শোধ করার সামর্থ নেই, তাই ধারও করিনা।"
"একদিন ডায়ালাইসিস করার পর ভাবতে হয় পরের ডায়ালাইসিসটা করতে পারবো তো? কিন্তু সপ্তাহে তিনদিন ডায়ালাইসিস করতে না পারলে শরীরে পানি জমে যায়, অনেক অসুস্থ হয়ে যাই," যোগ করেন তিনি।
এমন পরিস্থিতিতে মাসুদ রান এক নন।
তার মতোই আরেক কিডনিরোগী জাহিদের ডায়ালাইসিসে প্রতিমাসে খরচ হয় ২৫,০০০ টাকা। চার বছর ধরে সদ্য অনার্স পাশ করা জাহিদের চিকিৎসা করাতে গিয়ে বাড়ি পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছে তার পরিবারের।
৭৬এখন মাকে নিয়ে জাহিদ বোনের বাসায় থাকেন। বোনের সাহায্য ও অন্যদের অনুদানে ডায়ালাইসিস ও ওষুধের খরচ চলছে তার।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) এর এক সমীক্ষা অনুসারে, মাসুদ এবং জাহিদের মতো বাংলাদেশে কিডনি ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন রয়েছে— এমন পরিবারের ৯২ শতাংশই চিকিৎসার খরচ মেটাতে হিমশিম খায়।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হলো, যে কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন রয়েছে, তাদেরকে একটি সেফটি নেট প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত করা, যেন তাদের চিকিৎসা ব্যয় কিছুটা সাশ্রয়ী হয়। রোগী ও তার পরিবারকে আর্থিক ধাক্কা থেকে সুরক্ষা দিতে সরকারের প্রতি অতিরিক্ত তহবিল বরাদ্দেরও আহ্বান জানান তার। এছাড়া, খরচ কমাতে ডায়ালাইসিস চিকিৎসা বীমার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে বলে মত তাদের।
'আউট অফ পকেট কস্টস অফ কিডনি ডায়ালাইসিস ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক এই গবেষণাটি সোমবার (৯ ডিসেম্বর) 'ঢাকায় বার্ষিক বিআইডিএস কনফারেন্স অন ডেভেলপমেন্ট ২০২৪' এ উপস্থাপন করা হয়।
গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে কিডনি ডায়ালাইসিসের জন্য রোগীদের মাসিক খরচ ৬,৬৯০ টাকা থেকে শুরু হয়ে ২,১০,০০০ টাকা পর্যন্ত ওঠে— অর্থাৎ, ডায়ালাইসিসের গড় মাসিক খরচ ৪৬,৪২৬ টাকা। খরচের এই চাপে অনেক পরিবারই হয়ে যায় দিশাহার। এরমধ্যে অন্তত ৯২ শতাংশ পরিবার খরচ চালাতে হিমশিম খায়।
বিআইডিএস-এর রিসার্চ ফেলো আবদুর রাজ্জাক সরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিষয়ক সেশনে গবেষণার মূল ফলাফল উপস্থাপন করেন। তিনি জানান, ডায়ালাইসিসের জন্য বার্ষিক খরচ ৮০,২৮০ টাকা থেকে শুরু করে ২৫.২ লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
তিনি সরকারকে জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে ডায়ালাইসিস করানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং চিকিৎসাকে আরও সাশ্রয়ী করতে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তুকি দেওয়ার আহ্বান জানান।
"দরিদ্র পরিবারের জন্যও ডায়ালাইসিস চিকিৎসা সাশ্রয়ী করতে হবে," বলেন তিনি।
আবদুর রাজ্জাক সরকার কিডনি ডায়ালাইসিস রোগীদেরকে নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন। একইসঙ্গে, ডায়ালাইসিসের জন্য বীমা কভারেজ সুবিধা প্রদান এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো যেন চিকিৎসার ব্যয়বহুল ওষুধগুলো উৎপাদন করতে পারে, সেজন্য সরকারকে এ খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির আহ্বান জানান। এতে করে দরিদ্র পরিবারের ওপর চিকিৎসার ব্যয়ভার কমবে।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় ০.৮ মিলিয়ন মানুষের ডায়ালাইসিস প্রয়োজন, কিন্তু আর্থিক ও লজিস্টিক সহায়তার অভাবে মাত্র ৩০,০০০ মানুষ এই চিকিৎসা নিতে পারছেন।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ডায়ালাইসিস ফি (৩৫.৩ শতাংশ) এবং ওষুধের খরচ (২৩ শতাংশ) চিকিৎসা ব্যয় বাড়াতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে— যা মোট ব্যয়ের ৭৮.৭৯ শতাংশ।
ডাক্তাররা বলেন, যেসব রোগীর কিডনি কার্যকারিতা ১০-১৫ শতাংশের নিচে নেমে গেছে, তাদের জন্য ডায়ালাইসিস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডায়ালাইসিসের মাধ্যমে রোগীর শরীরে রক্ত থেকে বর্জ্য ও অতিরিক্ত তরল অপসারণ করা হয়, এটি ডায়ালাইসিস রোগীর জন্য জীবন-রক্ষাকারী এক চিকিৎসা।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, কিডনি ডায়ালাইসিস রোগীদের প্রায় ৯০ শতাংশ পরিবারই চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে আর্থিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। ফলে এ ধরনের পরিবারের প্রায় ১৯.৫ শতাংশ রোগী ডাক্তারের পরামর্শের চেয়ে কম সংখ্যক ডায়ালাইসিস সেশন গ্রহণ করেন।
সবচেয়ে দরিদ্র রোগীদের ৩০.২১ শতাংশ খরচ জোগাড় করতে না পারায় কম চিকিৎসা নেন।
২০২৩ সালের নভেম্বর এবং ডিসেম্বরে সরকারি, বেসরকারি এবং এনজিও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ভর্তি হওয়া ৪৭৭ জন রোগীর ওপর ভিত্তি করে সমীক্ষাটি চালানো হয়েছে।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিচালক ডা. মহিব উল্লাহ খন্দকার টিবিএসকে জানিয়েছেন, "ডায়ালাইসিস চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ ডায়ালাইসিসে সাবসিডি দেয়। ডায়ালাইসিস নিতে নিতে অনেক পরিবার আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যায়।"
তিনি বলেন, "আমাদের হাসপাতালে সবচেয়ে কম খরচে ডায়ালাইসিস দেওয়া হয় তারপরও এমন অনেক রোগী আছেন, যাদের সপ্তাহে তিনদিন ডায়ালাইসিস করার প্রয়োজন হলেও একদিনও করতে পারেননা।"
"ডায়ালাইসিসকে একটি বিশেষ সার্ভিস হিসেবে দেখে এর দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। এখন দেশে ডায়ালাইসিসের যে খরচ আছে, তা কমিয়ে আনতে রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিতে হবে। একইসঙ্গে ডায়ালাইসিসের টিউব, ওষুধের দাম কমাতে হবে," যোগ করেন তিনি।