বাংলাদেশে কেন বাঘের সংখ্যা কমছে?
বাঘ সংরক্ষণে গত দুই দশকে ক্রমাগতভাবে উল্লেখযোগ্য অর্থ ব্যয় করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, অদক্ষ ও অদূরদর্শী পদক্ষেপের কারণে এতে কার্যকরী সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি।
সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার গৃহীত প্রকল্পগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, দেশে বাঘ সংরক্ষণে এখন পর্যন্ত ১১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে। তার বিপরীতে দেশে ২০১৮ সালে বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা কমে ১১৪ টি হয়। যদিও এতসব উদ্যোগ গ্রহণের আগে ২০০৪ সালে বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৪০টি।
বাংলাদেশে রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। মূলত বাংলাদেশ ও ভারতজুড়ে এই বনের বিস্তৃতি।
বনটিতে বেঙ্গল টাইগার ও হরিণসহ রয়েছে আরও বহু বন্য প্রাণীর আবাসস্থল। এক্ষেত্রে বেঙ্গল টাইগারকে আবার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য কনজারভেশন অফ নেচার (আইইউসিএন) বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে ঘোষণা করেছে।
বাংলাদেশের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটান ও মায়ানমারেও বেঙ্গল টাইগারের আবাস রয়েছে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড (ডব্লিউডব্লিউএফ) অনুসারে, চীন, রাশিয়া, ভারত, নেপাল এবং ভুটানে প্রাণীটির সংখ্যা স্থিতিশীল অথবা ক্রমবর্ধমান। ডব্লিউডব্লিউএফ-এর অনুমান মতে, বিশ্বব্যাপী ১৩টি দেশে বনাঞ্চলে মোট ৫ হাজার ৫৭৪টি বাঘ রয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার ২০২০ সালে সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ বা ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সুরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর আগে সুরক্ষিত অঞ্চলের পরিমাণ ছিল ২৩ ভাগ।
এছাড়াও বাংলাদেশ সরকার সুন্দরবনে বন্যপ্রাণীর জন্য তিনটি অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে। তবে এই তিনটির কোনটিই বিশেষভাবে বাঘের জন্য নয়।
অন্যদিকে বাংলাদেশ বন বিভাগের মতে, দেশে ২৫টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য রয়েছে। কিন্তু এর কোনোটিই আলাদ করে বাঘের জন্য নয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের পরিচালক আবু নাসের মহসিন হোসেন বলেন, "সুন্দরবনের একটি বড় অংশকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তবে আমরা বাঘের জন্য একটি নির্দিষ্ট এলাকা ঘোষণা করতে পারিনি। কারণ বাঘ সারা বনে ঘুরে বেড়ায়। তারা কখনো এক জায়গায় থাকে না। তাই বাঘের জন্য আলাদাভাবে এলাকা তৈরি করা সম্ভব নয়। বরং এটা তাদের প্রাকৃতিক বাসস্থানকে ব্যাহত করবে।"
মহসিন হোসেন জানান, ভারতে ৫০টিরও বেশি বাঘ সংরক্ষণ এলাকা রয়েছে। সেই হিসেবে সুন্দরবনের বাংলাদেশের অংশটি টেকনিক্যালি একটি একটি বাঘ সংরক্ষণাগার বলে মনে করেন তিনি।
সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশ বাঘ সংরক্ষণের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে টাইগার অ্যাকশন প্ল্যান (২০০৯-১৭), বাংলাদেশ টাইগার অ্যাকশন প্ল্যান (২০১৮-২৭), জাতীয় বাঘ পুনরুদ্ধার কর্মসূচি এবং বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২।
বাংলাদেশ ২০০৪ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে বেঙ্গল টাইগার সংরক্ষণে বেশকিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত এই কার্যক্রমগুলোর ফলাফল উল্লেখযোগ্য নয়।
এদিকে ২০১০ সালে ইন্টারন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন ফোরাম রাশিয়ায় একটি শীর্ষ সম্মেলন করে। যেখানে বনাঞ্চলে বাঘ থাকা দেশগুলো ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দেয়।
বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাঘের আবাসস্থল রয়েছে এমন দেশগুলো প্রতি চার বছর পরপর অগ্রগতি পর্যবেক্ষণে জরিপ পরিচালনা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অবশ্য সেই অনুযায়ী বাংলাদেশ জরিপ করলেও বাঘের সংখ্যা বাড়ছে না। অন্যদিকে নেপাল ও ভারতে কিন্তু বাংলাদেশের তুলনায় বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে।
ভারতের ৫০টি বাঘ সংরক্ষণ এলাকায় বিশ্বের ৮০ ভাগ বাঘ রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ তাদের মধ্যে একটি। এটি একইসাথে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। ভারত, নেপাল ও ভুটানও বনাঞ্চলকে বাঘ সংরক্ষণ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাঘের অভয়ারণ্য এখন মিয়ানমারে। ধারণা করা হচ্ছে , হুকাউং ভ্যালি টাইগার রিজার্ভটি ক্রমান্বয়ে পুরো উপত্যকা জুড়েই বিস্তৃত হবে, যা আয়তনে প্রায় ২১ হাজার ৯৭০ বর্গ কিলোমিটার।
এদিকে বাংলাদেশ সরকার ২০২০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঘ ছাড়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। যা মূলত ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী অঞ্চল। তবে সম্ভাব্যতা সমীক্ষার ফলাফল বিবেচনায় সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি।
মহসিন হোসেন বলেন, "বাংলাদেশে সুন্দরবন ছাড়া এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে বাঘ নিরাপদে থাকতে পারে। একসময় (ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে) বাংলাদেশের ১৯টি জেলা ছিল; এর মধ্যে ১৭টি জেলা ছিল বাঘের আবাসস্থল। কিন্তু আজকাল মানুষ হয়ত এটা বিশ্বাস করবে না। কিন্তু প্রতিটি জেলায় শেষ বাঘটি মৃত্যুর পুরো রেকর্ড পর্যন্ত আমাদের কাছে রয়েছে।"
স্বাভাবিকভাবেই, বাঘ রক্ষায় সরকারের গৃহীত প্রকল্পের ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কিছু কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, সম্ভাব্যতা যাচাই ও তহবিলের অব্যবস্থাপনা কারণেই এমনটি হয়েছে।
মহসিন হোসেন বলেন, "সর্বশেষ প্রকল্প অর্থাৎ সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প ২০২২-২০২৫ বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সম্পূর্ণ অর্থায়িত প্রকল্প। প্রতিটি প্রকল্পের ব্যয় আমরা আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করি। ২০১৮ সালে ইউএস এইড আমাদের একটি পয়সাও দেয়নি। তারা যেখানে প্রয়োজন মনে করেছে সেখানে সেই অর্থ ব্যয় করেছে। এখানে আমাদের কিছুই করার ছিল না। আর বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা বাঘ সংরক্ষণের জন্য বাঘ জরিপ এবং অন্যান্য সচেতনতা তৈরির কার্যক্রম করেছি।"
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশে কর্মরত একজন বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ মঙ্গাবেকে বলেন, "বাংলাদেশ বাঘ সংরক্ষণের জন্য যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করেছে এবং ব্যয় করেছে তাতে ইতিবাচক ফলাফলের পাশাপাশি বাঘের সংখ্যা কমপক্ষে দ্বিগুণ হওয়ার কথা ছিল। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে তা হয়নি। দাতা ও সরকারি সংস্থার মধ্যে দুর্বল সমন্বয় এবং সংরক্ষণ ব্যবস্থার অনুপস্থিতিসহ বিভিন্ন কারণে এমনটা ঘটেছে।"
অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান