গ্যাসের চাহিদা বাড়ায় গানভোর সিঙ্গাপুর থেকে এলএনজির ২৪টি চালান কিনবে সরকার
দেশে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে গ্যাসের চাহিদা। যা মেটাতে গানভোর সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড থেকে প্রথমবারের মতো স্বল্পমেয়াদি চুক্তির অধীনে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি)-র ২৪টি চালান বা কার্গো কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
ট্যাঙ্কার জাহাজে করে প্রতিটি চালানে আসবে ৩৩.৬০ লাখ এমএমবিটিইউ (মেট্রিক মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট) এলএনজি। যার দাম নির্ধারণ করা হবে জেকেএম (জাপান কোরিয়া মার্কার) ইনডেক্স অনুসারে।
গত ১৩ মার্চ এই ক্রয় প্রস্তাব পাঠায় জ্বালানি বিভাগ। গত ২৭ মার্চ অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি এর নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে।
এ বিষয়ে ২৮ মার্চ পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার টিবিএসকে বলেন, "এই প্রথমবারের মতো স্বল্পমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজির কার্গো আমদানি করবে বাংলাদেশ। প্রতি মাসে একটি করে কার্গো সরবরাহ করবে কোম্পানিটি। তবে এক্ষেত্রে সুযোগ রয়েছে যে– প্রয়োজন হলে নেওয়া হবে, প্রয়োজন নাহলে নেওয়া হবে না। তবে চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হচ্ছে, জেকেএম ফর্মুলা অনুসারে দাম নির্ধারণ করা হবে। এছাড়া অন্যান্য শর্তও বাংলাদেশের অনুকূলে রয়েছে। বাংলাদেশ এই ব্যবস্থার ভালো সুবিধা পাবে বলেই আশা করা হচ্ছে।"
জ্বালানি সচিব মো. নূরুল আলম টিবিএসকে বলেন, "অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে গানভোর সিঙ্গাপুরের দেওয়া প্রস্তাবটির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এখন তাঁদের থেকে দামের প্রস্তাব পেলে– সেটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে উপস্থাপন করা হবে।"
গানভোরের প্রস্তাবিত দামের বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি সচিব বলেন, বিভিন্ন কোম্পানির সাথে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি কেনার ছয়টি চুক্তি রয়েছে। বাজারমূল্য সম্পর্কেও আমাদের সুস্পষ্ট ধারণা আছে। এছাড়া গানভোর সিঙ্গাপুর একটি ফর্মুলা (জেকেএম) অনুসরণ করবে। ফলে মূল্যায়ন করা কঠিন কিছু নয়।"
গত ১০ জানুয়ারি সিঙ্গাপুরের এই কোম্পানিটি এলএনজি সরবরাহ বিষয়ে একটি প্রস্তাব দাখিল করে। প্রস্তাবে স্বল্পমেয়াদে ২০২৪ সালে ১২ কার্গো এবং ২০২৫ সালে আরো ১২ কার্গো এলএনজি সরবরাহ করার প্রস্তাব দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ বিষয়ে গত ৪ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়েরও মন্ত্রী— ক্রয় প্রস্তাবে তাঁর নীতিগত অনুমোদন দিয়েছেন।
বর্তমানে কাতার ও ওমানের সাথে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি কিনছে সরকার। আর গানভোর সিঙ্গাপুর লিমিটেডসহ বিশ্বের ২৩টি কোম্পানির কাছ থেকে দরপত্রের মাধ্যমে স্পট এলএনজি ক্রয় করে।
গত ২৩ জানুয়ারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি– সুইজারল্যান্ডের টোটাল এনার্জিস গ্যাস অ্যান্ড পাওয়ার লিমিটেড এর থেকে এক কার্গো এলএনজি কেনার অনুমোদন দেয়। যেখানে প্রতি এমএমবিটিইউ এর দাম হচ্ছে ১০ ডলার ৮৮ সেন্ট।
এপ্রিলে গানভোর লিমিটেডের থেকে স্পট এলএনজির আরেকটি কার্গো আসবে, এই চালানের প্রতি এমএমবিটিইউয়ের দাম ৯ ডলার ৩৭ সেন্ট সরকার।
আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেট বা খোলাবাজার থেকে এলএনজি ক্রয় ছাড়াও– সরকার ওমান ও কাতার থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির অধীনে এলএনজি কেনে জ্বালানি বিভাগ। মহেশখালীতে স্থাপিত দুটি এলএনজি টার্মিনালের মাধ্যমে এসব চালান গ্যাসে রুপান্তর করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়।
তবে এই প্রথম দুই বছর মেয়াদি চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ গানভোর সিঙ্গাপুরের থেকে এলএনজির ২৪টি চালান কিনবে।
জ্বালানি বিভাগ এই সিদ্ধান্তের পেছনে যুক্তি হিসেবে বলেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম ব্যাপক ওঠানামা করছে, এতে এলএনজি সংগ্রহ করা জটিল হয়ে পড়ছে। এজন্যই দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির বদলে এখন তারা স্বল্পমেয়াদি চুক্তির অধীনে এলএনজি কিনতে চাইছে।
পেট্টাবাংলার সাম্প্রতিক কয়েক বছরের স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনার তথ্য পর্যালোচনা করে দরের বড় ওঠানামা লক্ষ করা গেছে। যেমন ২০২২ সালে সর্বোচ্চ ৩৮ ডলার ৯৩ সেন্ট থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন ২৪ ডলার ২৫ সেন্ট দরে স্পট এলএনজি কিনেছে পেট্রোবাংলা।
২০২৩ সালে পেট্রোবাংলা সর্বোচ্চ ১৯ ডলার ৭৪ সেন্ট এবং সর্বনিম্ন ১০ ডলার ৯৭ সেন্ট দরে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজি কিনেছে। আর ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত যে এলএনজি কেনা হয়েছে তার সর্বোচ্চ দর ছিল প্রতি এমএমবিটিইউ ১৫ ডলার ৯৬ সেন্ট, এবং সর্বনিম্ন ৯ ডলার ৭৭ সেন্ট।
বাংলাদেশ কেন এই স্বল্পমেয়াদি চুক্তিতে এলএনজি কিনতে যাচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে জ্বালানি সচিব মো. নূরুল আলম বলেন, দেশে গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। শিল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানির চাহিদা বেড়েছে। সে অনুযায়ী, সরবরাহ নিশ্চিত করাও জরুরী। নতুবা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশংকা রয়েছে। এজন্য এ ধরনের স্বল্পমেয়াদে সরবরাহের চুক্তিতে যাওয়া হচ্ছে। এর পাশাপাশি প্রয়োজন অনুযায়ী, স্পট মার্কেট থেকেও এলএনজি কেনা হবে।
তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ ওমান ও কাতার থেকে বছরে ৫৬ কার্গো এলএনজি পায়। দুটি এলএনজি টার্মিনালের বর্তমান সক্ষমতা অনুযায়ী এর বাইরে বছরে আরও ৫৮ কার্গো এলএনজি বাংলাদেশ প্রক্রিয়াজাত করতে পারে।
"যদিও গত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে দামের কারণে এতটা কেনা হয়নি। এবছর দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির বাইরে কমপক্ষে ৪৮ কার্গো এলএনজি কিনতে হবে। আগামী জুনের মধ্যেই দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির বাইরে কমপক্ষে ২৫ কার্গো এলএনজির প্রয়োজন," যোগ করেন জ্বালানি সচিব।
চাহিদা ও সরবরাহ
পেট্রোবাংলার মতে, দেশে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ৩ হাজার ৮০০ – ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফডি)।
পেট্রোবাংলার তথ্য বলছে, গত ২৮ মার্চ পর্যন্ত স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে ২ হাজার ৩০ এমএমসিএফডি এবং এলএনজি আমদানির মাধ্যমে ৬২০ এমএমসিএফডি গ্যাস পাওয়া গেছে। মার্চ মাসের পুরোটা সময় এই সরবরাহের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৭২০ এমএমসিএফডি।
আমদানিকৃত এলএনজি পুনরায় গ্যাসে রুপান্তর করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহের জন্য কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান স্টোরেজ অ্যান্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট বা এফএসআরইউ স্থাপন করা হয়েছে। এই দুটি টার্মিনালের দৈনিক সক্ষমতা ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট।
এরমধ্যে একটি এফএসআরইউ এর মালিকানা হচ্ছে এক্সিলারেট এনার্জি বাংলাদেশ লিমিটেডের, অন্যটি হলো সামিট গ্রুপের।
রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে সামিটের এফএসআরইউ টার্মিনালের। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে এখান থেকে আবারো গ্যাস সরবরাহ শুরু হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দুটি টার্মিনালই সচল হলে দেশের গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।