'সাম্প্রতিক ঘটনায়' কেএনএফের সাথে সংলাপ সম্ভব নয়: শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি
পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সাথে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য গঠিত হওয়া শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি বলেছে, 'সাম্প্রতিক ঘটনায়' কেএনএফের সাথে আর সংলাপ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
বৃহস্পতিবার (৪ এপ্রিল) জেলা পরিষদের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে এ কথা জানিয়েছেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির আহ্বায়ক ক্য শৈ হ্লা মারমা।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে ক্য শৈ হ্লা মারমা বলেন, অতি সাম্প্রতিক ঘটনায় শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি তীব্রভাবে মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ। এসব ঘটনায় চলমান সকল ধরনের প্রচেষ্টা পদানত ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
তিনি বলেন, "এমতাবস্থায় এ কমিটি মনে করে, এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে কেএনএফ শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সাথে সংলাপ করার সকল ধরনের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। তার কারণে আগামীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির পক্ষে সংলাপ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।"
মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) রাতে রুমা উপজেলার সোনালী ব্যাংক শাখায় অর্থ লুটের উদ্দেশ্যে হামলা চালায় একদল দুর্বৃত্ত সশস্ত্র গোষ্ঠী। ব্যাংকের ম্যানেজারকে অপহরণ করা সহ পুলিশ ও আনসার সদস্যের ১৪টি অস্ত্র লুট করে নিয়ে যায় তারা। পরের দিন বুধবার (৩ এপ্রিল) ভরদুপুরে থানচি উপজেলার সোনালী ব্যাংক শাখায় এবং কৃষি ব্যাংক শাখায় ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে একই কায়দায় হামলা চালায় দুটি জিপ গাড়ি ভর্তি সশস্ত্র লোকজন।
এ ঘটনায় পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
বান্দরবান জেলা পরিষদে অনুষ্ঠিত এ সংবাদ সম্মেলনে রুমা উপজেলার সোনালী ব্যাংক এবং থানচি উপজেলার সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকে হামলার ঘটনায় শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির পক্ষ থেকে নিন্দা জানানো হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে ক্য শৈ হ্লা মারমা আরো বলেন, সশস্ত্র সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য গত বছরের ২৯ মে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধির উপস্থিতিতে অরুণ সারকি টাউন হলে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। পরে জুন মাসে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে ১৮ সদস্য বিশিষ্ট শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠন করা হয়।
তিনি বলেন, "পরবর্তীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি ও কেএনএফের মধ্যে কয়েক দফা ভার্চুয়াল মিটিং করা হয়। পরে সবার মতামতের ভিত্তিতে সরাসরি সংলাপে বসার সুযোগ হয়। গত বছর ৫ নভেম্বর এবং এ বছরের মার্চে সরাসরি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে।"
তিনি যোগ করেন, "উভয় সংলাপে কেএনফের সকল প্রকার সশস্ত্র কার্যক্রম হতে বিরত থাকা ও অন্যান্য বিষয় সংক্রান্ত দুটো সমঝোতা স্মারক সম্পাদিত হয়। কিন্তু তারা সম্পূর্ণভাবে চুক্তিভঙ্গ করে বিভিন্ন সময় সশস্ত্র কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। কমিটির পক্ষ থেকে বিষয়টির ব্যাপারে বারবার অবগত করা হলেও তারা কর্ণপাত করেনি। বিভিন্ন সময় স্থানীয়দের উপর হামলা, অপহরণ ও চাঁদাবাজি চালিয়ে যায় তারা।"
সংবাদ সম্মেলনে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির মুখপাত্র ও জেলা পরিষদের সদস্য কাঞ্চনজয় তঞ্চঙ্গ্যা, শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সচিব ও বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতি জারলমময় বম সহ কমিটির অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
কারা এই কুকি-চিন?
২০২২ সালের শুরুর দিকে বান্দরবানের রুমা উপজেলায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে একটি সশস্ত্র সংগঠনের কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে জানা যায়। বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, খুমি ও ম্রোদের নিয়ে কেএনএফ গঠন করা হয়েছে বলে দাবি করা হলেও সেখানে বম জনগোষ্ঠীর কিছু সংখ্যক লোকজন রয়েছেন। যার কারণে সংগঠনটি পাহাড়ে 'বম পার্টি' নামে পরিচিতি পায়।
কেএনএফের ফেইসবুক পেইজে তারা জানায়, রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাইছড়ি, বিলাইছড়ি ও বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদমসহ নয়টি উপজেলা নিয়ে 'কুকি-চিন রাজ্য' গঠন করা হবে।
পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে তারা। তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে আতঙ্কিত হয়ে পাঁচ শতাধিক বম নারী-পুরুষ পালিয়ে ভারতের মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছিল।
২০২২ সালে অক্টোবর মাসে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে র্যাব জানিয়েছিল, সশস্ত্র সংগঠনটি অর্থের বিনিময়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন 'জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া' সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
এরপর ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে জঙ্গি ও কেএনএফ সদস্যদের বিরুদ্ধে রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলায় অভিযান চালায় র্যাব ও সেনাসদস্যদের যৌথ বাহিনী। পরবর্তীতে এ অভিযান চালানো হয় থানচি উপজেলাতেও। এরই মধ্যে অভিযান চালাতে গিয়ে নিহত হয়েছেন সেনাবাহিনীর বেশ কিছু সদস্যও। সংঘাতে প্রাণ গেছে কেএএনএফ সদস্যেরও।
তবে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটেছে গত বছরের ৬ এপ্রিল রাতে। সেদিন বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার খামতাং পাড়া থেকে আটজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। শুরুতে তাদের পরিচয় নিশ্চিত না হওয়া গেলেও পরে জানা যায়, তারা সবাই বম সম্প্রদায়ের।
কেএনএফের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষের পর ২০২৩ সালের মে মাসে বান্দরবানে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের নিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠিত হয়। এরপর ২০২৩ সালের জুলাই ও অগাস্টে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি ও কেএনএফের মধ্যে দুবার ভার্চুয়াল আলোচনা হয়।
একই বছরের ৫ নভেম্বর রুমা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে মুনলাই পাড়ায় প্রথমবারের মত কেএনএফের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সরাসরি দুটো বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে প্রথমবারের মত প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।
আলোচনা শুরুর পর পাহাড়ে বম পার্টির সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহিংসতা কিছুটা কমে এসেছে বলে মনে করছিলেন পাহাড়িরা। বান্দরবানের বিভিন্ন উপজেলায় যে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ছিল, তাও তুলে নেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যেই আবার ব্যাংকে হামলা ও ডাকাতির ঘটনায় নতুন করে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।