ভেজাল ওষুধে হুমকির মুখে দেশের স্বাস্থ্যখাত
গত বছরের ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ককলিয়ার ইমপ্লান্টের জন্য অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার পর তিন শিশুর মৃত্যু ভাবিয়ে তোলে বিএসএমএমইউ প্রশাসনকে। সন্দেহ থেকে অ্যানেস্থেসিয়ায় ব্যবহৃত 'হ্যালোথেন' পরীক্ষা করতে ল্যাবরেটরিতে পাঠায় তারা। টেস্টের রিপোর্টে মেলে হ্যালোথেনে ভেজালের তথ্য।
এই তিন শিশু ছাড়াও গত তিন-চার মাসে রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও টাঙ্গাইলে অ্যানেস্থেসিয়ার প্রয়োগের পর শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
ভেজাল হ্যালোথেনের বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় সারাদেশের সকল সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোর অপারেশন থিয়েটারে ইনহেলেশনাল অ্যানেস্থেটিক হিসেবে হ্যালোথেনের পরিবর্তে আইসোফ্লুরেন/সেভোফ্লুরেন ব্যবহার করাসহ বেশকিছু নির্দেশনা দিয়েছে।
হ্যালোথেনের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি ওষুধে ভেজাল হলে দেশের পুরো ওষুধ মার্কেটের কী অবস্থা হতে পারে, তা নিয়ে চিন্তিত স্বাস্থ্যখাতের পেশাদাররা।
তবে হ্যালোথেনের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হলেও লিভার সিরোসিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যালবুমিন ইঞ্জেকশন ভেজালের বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই এখন পর্যন্ত। এই ওষুধটিতেও ভেজাল দেওয়া হচ্ছে। তাই অনেক চিকিৎসকই ঝুঁকি এড়াতে এই ওষুধ এখন আর ব্যবহার করছেন না। গত বছরের নভেম্বরে এক নকল অ্যালবুমিন প্রস্তুতকারীকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কয়েক মাস আগে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত এক রোগীকে অ্যালবুমিন ইঞ্জেকশন দেওয়ার পর সেই রোগী মারা যায়। এরপর আরও কয়েকজন রোগীকে ওই ইনজেকশন দেওয়ার পর জটিলতা দেখা দেওয়ায় আইসিইউতে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ্য করা হয়। পরবর্তীতে সিলেট ওসমানি মেডিকেলের চিকিৎসকেরা অ্যালবুমিন ওষুধ ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেন।
সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. কবির আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মূলত লিভার সিরোসিসের রোগীদের জন্য সাপোর্টিভ ড্রাগ হলো অ্যালবুমিন। লিভারে পানি চলে আসলে এই ইনজেকশন দিলে রোগীর ইমপ্রুভ হয়। এছাড়া, কিডনি বা অন্যান্য রোগেও মাঝে মাঝে এটি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এই ড্রাগের ক্যান্ডিডেট কম, তাই হ্যালোথেনের মত এটি নিয়ে আলোচনা হয়নি।"
ডা. কবির আহমেদ জানান, গত ৫-৬ মাস ধরে ভেজাল অ্যালবুমিন বেশি পাওয়া যাচ্ছে। সরকারি হাসপাতালে সাধারণত আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল রোগীরা বেশি আসে, তারা যখন ৭-৮ হাজার টাকায় এই ওষুধটা এনে দেয় এবং ইনজেকশন দেওয়ার পর যখন রোগী মারা যায় বা আইসিইউতে নিতে হয়, তখন রোগীর পরিবার ডাক্তারদেরই দোষ দেয়। "তাই আমরা বাধ্য হয়ে এই ওষুধ আর ব্যবহার করছিনা, এতে রোগীরা বেশি সাফার করছে।"
সিলেট ওসমানি মেডিকেলের গ্যাস্ট্রোএন্টারলজি ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে ভেজাল অ্যালবুমিনের বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালককেও জানানো হয়েছে।
শুধু সিলেট ওসমানি মেডিকেল কলেজ নয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভেজাল অ্যালবুমিনের কারণে রোগী মৃত্যু বা রোগীর ক্রিটিক্যাল পরিস্থিতির পর আইসিইউতে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
বিএসএমএমইউ এর গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. চঞ্চল চৌধুরী বলেন, "ভেজাল অ্যালবুমিনের কারণে রোগীদের বিভিন্ন ধরনের রিঅ্যাকশন হচ্ছে, আমাদের হাসপাতালেও কয়েকজন রোগীকে আইসিইউতে নিতে হয়েছে। এখন রোগীরা খুব ভালো ফার্মেসি থেকে এ ওষুধ কিনলে শুধু সেটি ব্যবহার করছি আমরা।"
সম্প্রতি ফেসবুকে এক চিকিৎসক লিখেছেন, 'নকল অ্যালবুমিন, নকল পেথেডিন, নকল হ্যালোথেন... আর রোগী মরলেই সব দোষ ডাক্তারের!! এসব নকল ঔষুধের বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিকার, ঔষুধ প্রশাসনের কারোই কোনো অভিযান এখনো পর্যন্ত দেখলাম না!'
আটা-ময়দা দিয়ে তৈরি হতো অ্যান্টিবায়োটিক
চাহিদা কম কিন্তু বাজারে অপ্রতুল, এমন অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধগুলোকে টার্গেট করে বানানো হতো নকল অ্যান্টিবায়োটিক। নকল মোড়কে এসব ওষুধ বাজারে ছাড়া হতো। মোড়কের ভেতরে থাকত আটা–ময়দা দিয়ে তৈরি ক্যাপসুল বা ট্যাবলেট।
গত ৩১ মার্চ মতিঝিল ও বরিশাল কোতোয়ালি এলাকা থেকে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩০০ পিস নকল অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট জব্দ করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি), যার বাজারমূল্য প্রায় ২ কোটি টাকা। এ সময় ৫জনকে গ্রেপ্তারও করে ডিবি।
১ এপ্রিল রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, চক্রটি ঢাকার সাভার ও কুমিল্লায় কারখানা তৈরি করে এ ট্যাবলেট তৈরি করত। পরে সেগুলো নিয়ে বরিশালে গুদামজাত করত। সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় কুরিয়ারের মাধ্যমে সরবরাহ করা হতো।
চক্রটি গত ৮-১০ বছর ধরে এ প্রতারণা করে আসছিল।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় মাঝে মাঝে পরিচালিত অভিযানে ভেজাল ওষুধ তৈরি করা এসব অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কিন্তু নকল ওষুধের সিন্ডিকেটের জোরে অল্প সময়ের মধ্যে জামিনে বের হয়ে আবারও একই অপরাধে জড়াচ্ছে তারা।
ভেজাল ও নকল ওষুধ বন্ধে স্বদিচ্ছার অভাব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের সাবেক অধ্যাপক ডা. মুনিরুদ্দিন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "কর্তৃপক্ষের স্বদিচ্ছার অভাবে ভেজাল ও নকল ওষুধ বন্ধ করা যাচ্ছেনা। কারা ভেজাল ওষুধ তৈরি করে, তা পুলিশ চাইলে এক ঘণ্টার মধ্যে ধরতে পারে।"
তিনি বলেন, দেশে লাখ লাখ ফার্মেসি, সেসব ফার্মেসি মনিটর করার জনবল নেই ওষুধ প্রশাসন অধিধপ্তরের কাছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের বড় কোনো পদে কোনো ওষুধ বিশেষজ্ঞ বা ফার্মাসিস্ট নেই। এর আগে নকল প্যারাসিটামলে শিশু মৃত্যুর প্রমাণ পাওয়ার পরও তারা শাস্তি পায়নি।
মানুষের মধ্যে ভয় নেই, তাই অসৎ মানুষেরা ওষুধে ভেজাল মেশাচ্ছে," যোগ করেন তিনি।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর কী করছে?
ভেজাল ওষুধ তৈরির অপরাধে সর্বোচ্চ ১০ বছরের জেল ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রেখে ওষুধ ও কসমেটিক আইন ২০২২ পাশ করেছে সরকার।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ১৬৯৬টি মোবাইল কোর্ট, ৮টি ড্রাগ কোর্ট ও ৪৪৭টি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে ১ কোটি ৭৩ লাখ ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে। তবে ভেজাল ওষুধের জন্য জেলে দেওয়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
ভেজাল ওষুধ বন্ধে সরকার কী করছে– জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন টিবিএসকে বলেন, "ওষুধের ভেজাল দেখার কাজ ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। আমি তাদেরকে এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছি।"
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. সালাউদ্দিন বলেন, "হ্যালোথেন ওষুধের দোকানে বিক্রি হয় না। হাসপাতালগুলো কোম্পানির এজেন্টের মাধ্যমে ওষুধগুলো কিনতো। যেহেতু ওষুধটি ফার্মেসিতে বিক্রি হয় না, তাই আমরা জানতাম না ওষুধটি নকল হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে নকল হ্যালোথেন ব্যবহার করা হচ্ছে কি-না, তা দেখতে আমরা মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়ে জানিয়েছি।"
"গত ২৭ মার্চ থেকে প্রতিদিন আমাদের টিম অভিযান চালাচ্ছে, তবে এখনো কোথাও নকল হ্যালোথেন পায়নি। হ্যালেথেন ছাড়াও অন্যান্য ভেজাল ওষুধ ধরতে মাঠ পর্যায়ে পোস্ট মার্কেট সার্ভিলেন্স ও কন্ট্রোল করা হয়।"
"তবে সমস্যা হলো আমাদের জনবলের ঘাটতি আছে। মাঠ পর্যায়ে এক-দুইজন কর্মকর্তা কাজ করেন," যোগ করেন তিনি।