পানির বিল আদায়ে ব্যর্থ ওয়াসা, লোকসান এড়াতে চাপ দেয়া হচ্ছে গ্রাহকদের
তীব্র গরমে নগরীর পানি সরবরাহকারী সংস্থাগুলো গ্রাহকদের পানির চাহিদা পুরন করতে হিমশিম খেলেও যতটুকু পানি আহরণ, শোধন ও বিতরণ করা হচ্ছে তার সম্পূর্ণ দাম পাচ্ছে না সংস্থাগুলো। অ-রাজস্বভুক্ত পানি সরবরাহের দিক থেকে চট্টগ্রামের অবস্থান তৃতীয় এবং ঢাকার অবস্থান পঞ্চম হওয়ায় এমনটি ঘটছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসা এবং ঢাকা ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে সংস্থাগুলোর বিলবিহীন পানি সরবরাহের পরিমাণ যথাক্রমে ৩৫ শতাংশ এবং ২২ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। কর্মকর্তারা এর জন্য মিটার রিডিং, পাইপলাইন লিকেজ এবং অবৈধ সংযোগের সমস্যাকে দায়ী করছেন।
অংশীজনরা জানিয়েছেন, প্রকল্পে লক্ষ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করার পরেও পানি সরবরাহকারী সংস্থাগুলোর লিকেজ সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হওয়া, বর্জ্য সংকট ও চুরির সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হওয়ায় নিয়মিত গ্রাহকদের ঘাটতি মেটাতে অর্থ প্রদান করতে হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, চট্টগ্রাম ওয়াসা বর্তমানে নগরবাসীর জন্য পানির শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ৫০ শতাংশ করতে চায়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় রাজি হলে চট্টগ্রামের প্রত্যেক পরিবারকে প্রতি ইউনিটে (১ হাজার লিটার) ২৩.৫০ টাকা এবং বাণিজ্যিক গ্রাহকদের ৫৫.৫০ টাকা দিতে হবে।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এশিয়ার অনেক শহরেই বিতরণ নেটওয়ার্কগুলোতে পানির অতিরিক্ত অপচয়কে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। পাশাপাশি ৩৫ শতাংশ ক্ষেত্রে কোন বিল ছাড়াই পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। নেটওয়ার্কে উচ্চ অনুপাতে পানির লিকেজ ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় এশিয়ার অনেক শহরেই যুক্তিসংগত ও সাশ্রয়ী পর্যায়ের শুল্ক নির্ধারণ করা কঠিন বলে মনে করে এডিবি।
বিল ছাড়াই পানি সরবরাহ করছে চট্টগ্রাম ওয়াসা
চট্টগ্রাম ওয়াসা ৫৯টি 'ডিস্ট্রিক্ট মিটারড এরিয়া' (ডিএমএ) এর মাধ্যমে পানি বিতরণ ও ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন করে ঘাততি কমাতে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে। প্রকল্পটি গত বছরের জুনে শেষ হলেও প্রত্যাশিত ফলাফল দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রকল্পটি এখন পর্যন্ত বন্দর শহরের অর্ধেকেরও বেশি পানি সংযোগকে একটি নিবিড় পর্যবেক্ষণ নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে পারলেও অ-রাজস্বভুক্ত পানি সরবরাহের পরিমাণ বেড়েছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার তথ্যমতে, ২০২৩ সালের জুলাই মাসে প্রকল্পটি সম্পন্ন হওয়ার পর থেকে অ-রাজস্বভুক্ত পানির হার জুলাই মাসে ছিল ৩৫ শতাংশ, আগস্ট মাসে ৩২ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল ৩১ শতাংশ।
পূর্বে একই বছরের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারিতে যখন প্রকল্পটি অসম্পূর্ণ ছিল তখন অ-রাজস্বভুক্ত পানির হার ছিল যথাক্রমে ৩১ শতাংশ এবং ৩০ শতাংশ। অথচ ২০১৮ সালেও এই হার কোনো কোনো মাসে ১৫ শতাংশও ছিল।
চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) একেএম ফজলুল্লাহ টিবিএসকে বলেন, আগামী ৩-৪ মাসের মধ্যে অ-রাজস্বভুক্ত পানির হার ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
তিনি বলেন, "মিটার রিডিংয়ের সমস্যা আছে। আবাসিক ভবন ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে অবৈধ সংযোগ আছে। আমরা অভিযান চালিয়ে এসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি।"
এদিকে ঘাটতি কমানোর জন্য প্রকল্পের সাথে জড়িত কর্মকর্তারা বলছেন, অ-রাজস্বভুক্ত পানির হার ১০ শতাংশের কম যা এ প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল। কিছু এলাকায় এটি ২ শতাংশের কম। তারা বলছেন, চট্টগ্রাম ওয়াসার রাজস্ব বিভাগের অভ্যন্তরে গণনা সংক্রান্ত সমস্যার কারণে এই পার্থক্য দেখা দিয়েছে।
প্রকল্পটির পরিচালক ও চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার আগে ঠিকাদার ও পরামর্শক সংস্থা ও ওয়াসা মিলে নিরীক্ষা চালিয়েছে। অ-রাজস্বভুক্ত পানির হার ১০ শতাংশের কমে নেমেছে। রাজস্ব বিভাগের বিষয়টি নিয়ে কাজ করার কথা।"
অ-রাজস্বভুক্ত পানির হিসাবের গরমিল নিয়ে ২০২০ সালে অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান চালিয়েছিল সংস্থাটি। এতে উঠে আসে, লিকেজ সমস্যার কারণে উৎপাদিত পানির মাত্র ৩.৮৯ শতাংশ অপচয় হয়। বাকি পানি অবৈধভাবে বিক্রি বা আহরণ করা হয় বলে অভিযোগ আছে।
সংস্থার রাজস্ব প্রধানও স্বীকার করেছেন, বর্জ্য, পাইপলাইন লিকেজ এবং অননুমোদিত সংযোগগুলো অ-রাজস্বভুক্ত পানির হার বৃদ্ধি করছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা রুমন দে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, পাইপলাইন দিয়ে পানি সরবরাহের সময়ও কিছু পানি অপচয় হয়। এছাড়া অবৈধ ও পাইপলাইনের মাধ্যমে লাইন নিয়ে পানি বিক্রি করা হয়। এসব কারণে ঘাটতি হয়।
চট্টগ্রাম ওয়াসার তথ্যমতে, বর্তমানে সংস্থাটির দৈনিক পানি উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ৫০ কোটি লিটার। নগরীর ৪০ শতাংশ মানুষের কাছে এখনো ওয়াসার পানি পৌঁছায়নি। পানির বিল ঠিকমতো না পাওয়ায় মাসে ১৪ থেকে ১৭ কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি হচ্ছে সংস্থাটির।
একই সংকটে ঢাকা ওয়াসা
গত দেড় দশকে ঢাকা ওয়াসা সামগ্রিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বিতরণ নেটওয়ার্ক বাড়াতে বিদেশি অর্থায়নে বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে।
এর মধ্যে ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম ও ঢাকা এনভায়রনমেন্টলি সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই প্রজেক্ট এর জন্য এডিবি এবং ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
ঢাকা ওয়াসার নথি অনুসারে, সরবরাহ বাড়াতে এবং পানির অপচয় কমাতে সংস্থাটি পরিষেবার অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলগুলোতে পর্যবেক্ষণ এবং মিটারিং সুবিধাসহ ১৫৬টি ডিএমএ বসানোর পরিকল্পনা করেছিল।
ঢাকা মহানগরীর ১০টি জোনের মধ্যে সাতটিতে প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। চলমান প্রকল্পগুলোর আওতায় না থাকা অঞ্চলগুলোতে পানির অপচয়কে পানি সরবরাহের ঘাটতির প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা সংস্থাটির ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে।
ঢাকা ওয়াসা উল্লেখ করেছে, এর কিছু পাইপলাইন ৫০ বছর আগে নির্মিত হয়েছিল। এমনকি কিছু পাইপলাইন ১৫০ বছর আগেও তৈরি করা হয়েছিল যা ছিদ্র হয়ে যাওয়ায় ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ পানির অপচয় ঘটছে।
ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম আহমেদ খান সাম্প্রতিক বিবৃতিতে বলেছেন, অ-রাজস্বভুক্ত পানি এবং ঘাটতির জন্য লিকেজ এবং অবৈধ সংযোগ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় দায়ী। তিনি বস্তি অঞ্চলে এবং নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর এলাকায় অননুমোদিত সংযোগের মাধ্যমে পাইপের পানি ব্যবহার করার কথাও উল্লেখ করেন।
তবে সংস্থাটির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট) একেএম শহীদ উদ্দিন টিবিএসকে বলেছেন, "ঢাকা ওয়াসার বর্তমান ওভারঅল সিস্টেম লস ২২%, যা আগের থেকে অনেক কমেছে।"
ঘাটতি হ্রাসের জন্য তিনি ডিএমএ প্রকল্পকে কৃতিত্ব দিয়েছেন। পরিকল্পিত ১৫৬টি ডিএমএ এর মধ্যে ১১৩টি সম্পন্ন হয়েছে। এ কারণে বিতরণ ও বিলিং ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
বাকি ডিএমএ নিয়ে কাজ চলছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, "ডিএমএ এলাকায় এখন সিস্টেম লস ৫ শতাংশের নিচে রয়েছে। ডিএমএ কমপ্লিট না হওয়া ৪৩টি এলাকায় সিস্টেম লস ৪০ শতাংশের উপরে।"
সব ডিএমএর কাজ শেষ হয়ে গেলে সামগ্রিক সামগ্রিক ঘাটতি ৫ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে আশা করেন তিনি।
বিগত ৯ বছরের ঢাকা ওয়াসার অডিট রিপোর্টের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত নয় বছরে গ্রাহকদের কাছ থেকে গড়ে ৯৮ শতাংশ রাজস্ব আদায় হয়েছে। সেই হিসেবে রাজস্ব আদায়ের অঙ্ক দাঁড়ানোর কথা ১৬ হাজার ৩৪৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে ১৩ হাজার ১১ কোটি ১৮ লাখ টাকা যেটি মোট রাজস্ব আদায়ের ৭৮ শতাংশ। অর্থাৎ ৩ হাজার ২২১ কোটি টাকার কোনো হিসেব নেই।
ঢাকা ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন পানির উৎপাদন হয় ২৭০ থেকে ২৭৫ কোটি লিটার। অর্থাৎ প্রায় ৬০ কোটি লিটার পানি প্রতিদিন লাইনের লিকেজের কারণে অপচয় হচ্ছে যার রাজস্ব পাচ্ছে না ওয়াসা। ফলে পানির উৎপাদন খরচ বাড়ছে এবং এর প্রভাব কমাতে গ্রাহক পর্যায়ে পানির মূল্য বৃদ্ধি করে দায় এড়াতে চায় ঢাকা ওয়াসা।
অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩ অর্থবছরে ঢাকা ওয়াসার রাজস্ব আদায় প্রকৃত পরিমাণের তুলনায় ৩১০ কোটি টাকা কম হয়েছে।
ঢাকা ওয়াসার অডিট রিপোর্ট এবং ২০১৫ থেকে ২০২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে রেকর্ড করা অ্যাকাউন্ট এবং বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সিস্টেম লসের জন্য দায়ী।