দেশজুড়ে তাপপ্রবাহের মধ্যে তীব্র লোডশেডিং, অতিষ্ঠ জনজীবন
চলমান তাপপ্রবাহে সারাদেশে সপ্তম বারের মতো হিট অ্যালার্ট চলছে। এর উপরে দেশজুড়ে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিভ্রাট অসহনীয় করে তুলেছে জনজীবন।
তীব্র গরমে গতকাল (২৮ এপ্রিল) স্কুল খোলার পর চট্টগ্রাম ও যশোরে হিটস্ট্রোকে দুই শিক্ষকের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ নিয়ে সারাদেশে হিটস্ট্রোকে অন্তত ৩৫ জনের মৃত্যু হলো। এছাড়া, প্রচণ্ড গরমে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলায় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অন্তত ১৭ শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়েছে বলেও জানা গেছে।
বিদ্যুতের কেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)-এর তথ্যে দেখা গেছে, রোববার (২৮ এপ্রিল) দুপুর ১২ টায় সারাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৫,৩৫০ মেগাওয়াট। এই সমইয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন হয়েছে ১৩,৩৯৮ মেগাওয়াট এবং লোডশেডিং হয়েছে ১,৮৬৪ মেগাওয়াট।
তবে সরকারের বিদ্যুৎ বিতরণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে কথা বলে জানা যায়, চাহিদার বিপরীতে সারাদেশে ২,০০০ মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং করতে হয়েছে গত কয়েকদিন ধরে।
দেশের ৮০ শতাংশের বেশি গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে দেশের সবচেয়ে বড় বিতরণ কোম্পানি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ।
আরইবির তথ্যমতে, গতকাল বিকাল ৩টায় দেশের গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং ২,৮০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। এসময় এসব অঞ্চলে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৯,৩১২ মেগাওয়াট। তবে এর বিপরীতে সরবরাহ ছিল মাত্র ৬,৫০০ মেগাওয়াট।
চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ এবং কুমিল্লার মতো অঞ্চলে লোডশেডিংয়ের হার ৪০ শতাংশ ছাড়িয়েছে; এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং হচ্ছে চট্টগ্রামে, ৫৪ শতাংশ।
এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) ও ন্যাশনাল লোড ডিসপ্যাচ সেন্টারের (এনএলডিসি) দৈনিক প্রতিবেদনে লোডশেডিংয়ের সঠিক তথ্য তুলে ধরা হচ্ছে না। প্রকৃত লোডশেডিংয়ের পরিমাণ আরও।
সারাদেশে দৈনিক বিদ্যুতের প্রকৃত ঘাটতি ২,০০০ মেগাওয়াটের বেশি থাকলেও সরকারি তথ্যে দেখানো হচ্ছে ১,০০০ মেগাওয়াটের একটু কম-বেশি। ঘাটতি বিদ্যুতের পুরোটাই দেশের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে পূরণ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) বিতরণ শাখার এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, "অনুমাননির্ভর বিদ্যুতের চাহিদা তৈরি করে তা প্রকাশ করা হচ্ছে। প্রকৃত পক্ষে লোডশেডিং আরও বেশি।"
আরইবির এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, "বর্তমানে আমাদের বিতরণ এলাকায় যে চাহিদা রয়েছে, সেই তুলনায় বিদ্যুৎ পাচ্ছি না। যার কারণে এই গরমের মধ্যেও বাধ্য হয়ে আমাদেরকে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। গ্রাম অঞ্চলে কোথাও কোথাও লোডশেডিংয়ের পরিমাণ ১০ থেকে ১২ ঘণ্টাও করতে হচ্ছে।"
গ্রামাঞ্চলে চাহিদা থাকে সাধারণত ৯ হাজার মেগাওয়াটের একটু কমবেশি। কিন্তু সংস্থাটি নিয়মিত পায় মাত্র ৭ হাজার মেগাওয়াটের মতো।
গত ১০ থেকে ১২ দিন যাবত সবেচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ ঘাটতি ছিল ময়মনসিংহ অঞ্চলে।
গত শুক্রবার এবং শনিবার, ছুটির দিনেও ময়মনসিংহ ও জামালপুরের গ্রামাঞ্চলের মানুষজন ১০ থেকে ১২ ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ পাননি। অথচ সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সাধারণ সময়ের তুলনায় বিদ্যুতের চাহিদা থাকে অনেকটাই কম।
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার তানজিলা মিলি বলেন, "আমাদের গ্রামে এখন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সর্বোচ্চ সাত-আট ঘণ্টার মতো বিদ্যুৎ পাচ্ছে মানুষজন। পল্লী বিদ্যুতের অভিযোগকেন্দ্রের নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও রিসিভ করেন না কর্মকর্তারা। এই গরমে বৃদ্ধা ও শিশুদের জন্য খুবই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।"
জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার বজলুর রশিদ টিবিএসকে বলেন, "আমাদের এলাকায় এখন ১৫ থেকে ১৭ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। এতে সেচের জমিগুলোর ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে বিদ্যুৎ না থাকায় লোকজন অসুস্থ হচ্ছে। এতে হাসপাতালেও রোগীর চাপ বেড়েছে।"
এদিকে রাজধানীতে বিদ্যুৎতের সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই বলে জানিয়েছে ঢাকার বিদ্যুৎ সরবরাহকারী দুই প্রতিষ্ঠান ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) এবং ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)।
লোডশেডিং না হলেও কারিগরি ত্রুটির কারণে কিছু কিছু এলাকায় স্বল্প সময়ের জন্য বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটি দুটি।
যদিও ঢাকার বাসিন্দা মোনতাসির মাহমুদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, 'গত দুই ঘণ্টায় ৪ বার কারেন্ট গিয়েছে। প্রতিবার বড় জোর ৫ মিনিট ছিল। কীভাবে বেঁচে থাকবো আমরা?'
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, "বিদ্যুৎ বিভাগ যেভাবে পরিকল্পনা করছে, তাতে এ বছর ১৬,০০০ মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, এবং সেই অনুযায়ী উৎপাদন করা হচ্ছে।"
"গত বছরের তুলনায় এ বছর নতুন করে ১,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। তাই গত বছরের তুলনায় লোডশেডিং কমছে– এমন নিশ্চয়তা দিতে পারছি না। সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫০০ থেকে ১,৫০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হওয়ার আশঙ্কা থাকছেই," যোগ করেন তিনি।
এদিকে সিলেট বিভাগ ছাড়া আগামী ২ মে পর্যন্ত চলমান তাপপ্রবাহ তেমন কমার পূর্ভাবাস নেই বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা।
কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ টিবিএসকে বলেন, "সিলেট বিভাগ ছাড়া আগামী ২ মে পর্যন্ত চলমান এ তাপমাত্রা বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উপরে অব্যাহত থাকবে। তারপর ৩-৮ মে এর মধ্যে দেশে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।"
"তবে ২ মে পর্যন্ত নাগরিকদের হিটস্ট্রোক থেকে বাঁচতে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া সূর্যের তাপে এড়িয়ে চলা উচিত হবে," যোগ করেন তিনি।