নিউমুরিং টার্মিনাল যেভাবে বদলে দিচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের সেবা
বাংলাদেশে বন্দর পরিষেবা পুনর্গঠনে 'গেম-চেঞ্জার' হিসবে কাজ করছে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউ মুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)। সীমিত সরঞ্জাম ও অবকাঠামোর সমন্বয়ে বিশেষায়িত এনসিটি সার্ভিস উত্তরোত্তর এগিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে এই টার্মিনাল থেকে চট্টগ্রাম বন্দর বছরে আয় করছে ১,০০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৫৫ শতাংশ কার্গো হ্যান্ডলিং হয় এই টার্মিনাল ব্যবহার করে।
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালে বার্ষিক কন্টেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা ১১ লাখ টিইইউ। যদিও এই টার্মিনালে বছরে ১৩ লাখ টিইইউ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হচ্ছে।
সক্ষমতার চেয়ে ১৫.৩৮ শতাংশ বেশি কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হলেও অপারেশনাল কার্যক্রম গতিশীল। উন্নত যন্ত্রপাতি, আধুনিক প্রযুক্তি, দক্ষ জনবল দিয়ে পরিচালনার কারণে ক্রমশ এই টার্মিনালে জাহাজ এবং কন্টেইনার হ্যান্ডলিং বেড়েছে ।
২০০৭ সালে বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে ৪,০০০ কোটি ব্যায়ে এনসিটি নির্মাণ এবং যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হয়। বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, কিছু সঠিক সিদ্ধান্ত বদলে দিয়েছে বন্দরের দৃশ্যপট।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট খায়রুল আলম সুজন বলেন, ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি প্রাইভেট সেক্টরে হ্যান্ডলিং দেওয়ায় যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত।
তিনি বলেন, "দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ায় দেশীয় শ্রমিকদের দক্ষতা বেড়েছে। এ পর্যন্ত বন্দর পরিচালনা খাতে চার হাজারের বেশি শ্রমিক দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছেন। এখন চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ কিংবা কন্টেইনার জট নেই। বন্দরের এই অভূতপূর্ব সাফল্যে বন্দর ব্যবহারকারী হিসেবে আমরা খুবই সন্তুষ্ট।"
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য মতে, চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে তিনটি টার্মিনাল— জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি), চট্টগ্রাম কন্টেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) এবং নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালে (এনসিটি) মোট ২০টি জেটির মধ্যে জাহাজ ভিড়ানোর কার্যক্রম চলে ১৯টিতে।
বন্দর ব্যবহারকারীরা জানিয়েছেন, ২০০৭ সালের আগে চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য খালাস এবং কন্টেইনার হ্যান্ডলিং পরিস্থিতি বর্তমানের তুলনায় ছিল ভিন্ন। চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে একটি জাহাজ ভিড়তে বহির্নোঙ্গরে অপেক্ষায় থাকতো গড়ে ১০ থেকে ১২ দিন। প্রতিদিন বিলম্বের জন্য আকার ভেদে প্রতিটি জাহাজকে ড্যামারেজ বাবদ গুনতে হতো ১২ থেকে ২০ হাজার ডলার। এতে বেড়ে যেতো ব্যবসার খরচ, পণ্য পরিবহন ব্যয়। বাড়তি এই শিপিং ড্যামারেজের কারণে বেড়ে যেতো পণ্যের দাম। বাড়তি এই টাকা শেষ পর্যন্ত বহন করতে হতো ভোক্তাকেই।
বর্তমানে বহির্নোঙ্গরে জাহাজের গড় অপেক্ষমান সময় ১২ দিন থেকে কমে নেমে এসেছে ২ থেকে ২.৫ দিনে। শুধু তাই নয়, কখনো কখনো চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গর থেকে সরাসরি জেটিতে প্রবেশ করতে পারছে জাহাজ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জাহাজ অন অ্যারাইভাল বার্থিং পাচ্ছে। বর্তমানে বন্দর বছরে আয় করছে ৩,৫০০ কোটি টাকার বেশি।
চট্টগ্রাম বন্দরের আয় থেকে সরকারি কোষাগার এবং অন্যান্য বন্দরের উন্নয়ন কাজে অনুদান হিসেবে ব্যয় হচ্ছে। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে অনুদান হিসেবে ৪৬১ কোটি ৯০ লাখ টাকা প্রদান করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সাল থেকেই এনসিটি পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে দেশের প্রথম টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম কন্টেইনার টার্মিনালও পরিচালনা করছে।
এছাড়া, চট্টগ্রাম বন্দরের জেনারেল কার্গো বার্থ পরিচালনা করছে ১২টি দেশীয় বার্থ অপারেটর প্রতিষ্ঠান। ২০২৩ সালে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ৩০ লাখ ৫০ হাজার টিইইউএস। বন্দরের বহির্নোঙ্গরে পণ্য খালাসের যুক্ত আছে ৩২টি দেশীয় শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর।
গত ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রাম বন্দর ১৩৭তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন করেছে। বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে নির্মাণ করা হচ্ছে নতুন জেটি, টার্মিনাল। আসছে নতুন বিনিয়োগ। ২০২৪ সালে শুধুমাত্র বে টার্মিনাল প্রকল্পে বিনিয়োগ হচ্ছে ১০ বিলিয়ন ডলার। চট্টগ্রাম বন্দর ঘিরে অন্যান্য টার্মিনালসহ অন্তত ৬টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, "আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধির সাথে সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতাও বাড়ানো হচ্ছে। নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালে গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ অধুনিক নানান যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হয়েছে। এতে বন্দরের সক্ষমতা বেড়েছে।"
"দেশীয় টার্মিনাল, বার্থ, শিপ হ্যান্ডিলিং অপারেটরগুলো বন্দরে জাহাজ, কন্টেইনার, কার্গো হ্যান্ডলিং ভালোভাবে সম্পন্ন করছে। এর ফলে প্রতিষ্ঠান এবং শ্রমিকরা দক্ষ হয়ে উঠছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে যন্ত্রপাতির সংকট নেই।"
তিনি আরো বলেন, "পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল চালু হচ্ছে আগামী মে অথবা জুনে। চট্টগ্রাম বন্দরের ছয়গুণ বড় বে টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শেষ হলে আগামী ৪ থেকে ৫ বছরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর এই অঞ্চলের হাব পোর্ট হিসেবে আবির্ভূত হবে।"
২০০৭ সালে চালু হওয়ার প্রথম বছরে এনসিটিতে বাণিজ্যিক জাহাজ আসে ৪৩৬টি। আর ২০২৩ সালে এনসিটিতে জাহাজ এসেছে ১,১৯৭টি। অর্থাৎ, ১৬ বছরের ব্যবধানে জাহাজ আসার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৬৩.৫৭ শতাংশ। জিসিবি, সিসিটি, এনসিটি এবং বহির্নোঙ্গর মিলিয়ে ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে বাণিজ্যিক জাহাজ এসেছে মোট ৪,১০৩টি।
এনসিটিতে জাহাজ জেটিতে এসে কন্টেইনার খালাস এবং রপ্তানি পণ্য বোঝাই করে বন্দর ত্যাগ করতে সময় লাগছে দুই থেকে সর্বোচ্চ তিনদিন। চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে আধুনিক, দ্রুত সেবা পাওয়ার নিশ্চয়তায় দেশি-বিদেশি সেবা গ্রহীতারা আস্থা তৈরি করতে পেরেছে বলে মনে করেন পোর্ট ইউজার্স ফোরাম ও এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম।
তিনি বলেন, "শ্রমিকরা দক্ষতা অর্জন করায় বিদেশ কর্মীর নির্ভরতা কমেছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে। একই ভাবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানেও দেশীয় কর্মীদের চাহিদা বাড়ছে। চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন প্রকল্পগুলোতে এসব দক্ষ কর্মীদের আরও বেশি বেতনে কাজ করার ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে।"
বাড়ছে টার্মিনাল
বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে ১,২২৯ কোটি টাকায় নির্মিত পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) কার্যক্রম শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে।
টার্মিনালটি পরিচালনায় চট্টগ্রাম বন্দর প্রথমবারের মতো বিদেশি অপারেটর রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনালকে নিয়োগ দিয়েছে। টার্মিনালটিতে একসাথে চারটি জাহাজ ভিড়ানো যাবে। বছরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা যাবে প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার টিইইউ।
২০২২ সালের জুলাইয়ে এই প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষ হলেও প্রায় দুই বছর পরও চালু করতে না পারায় বন্দর ব্যবহকারীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। শুরুতে এই টার্মিনালটি বন্দরের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালনার কথা থাকলেও সরকার সিদ্ধান্ত বদলে বিদেশি অপারেটর নিয়োগ করে।
গত ২৪ এপ্রিল সাংবাদিকদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম সোহায়েল বলেন, "লালদিয়ার চর এলাকায় এসটি কন্টেইনার টার্মিনাল করছে মায়ের্কস গ্রুপ। ইতোমধ্যে সব ধরনের সমীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। এ বছরই পিপিপি অ্যাক্ট এর আওতায় চুক্তি হবে।"
ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট হবে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর
কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলায় কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নির্মিত হয়েছে চ্যানেল এবং দুটি জেটি। সেখানে ভিড়ছে বড় জাহাজ। সেখানে পূর্ণাঙ্গ বন্দর নির্মাণের কাজ শুরু করতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আগমী ৩ থেকে ৪ বছরের মধ্যে গভীর সমুদ্র বন্দরের কার্যক্রম চালু হবে। সেখানে ভিড়তে পারবে ১৬ মিটার ড্রাফটের জাহাজ।
মেগা প্রকল্পে ধীরগতি
চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে সরকার ২০১৪ সালে বে-টার্মিনাল প্রকল্প হাতে নেয়।
২০১৮ সালের ১ নভেম্বর বে-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ভূমি সংক্রান্ত জটিলতা, বিনিয়োগ, প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে বার বার সিদ্ধান্ত বদলের কারণে এখনও কাজ শুরু করতে পারেনি বন্দর।
২০২৬ সালে নতুন এই বন্দরে জাহাজ ভেড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হলেও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, বে টার্মিনাল নির্মাণে আরও ৪ থেকে ৫ বছর সময় লাগবে।