দেশে যখন বাড়তি বিদ্যুৎ প্রয়োজন, তখন একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা ৩০% কমেছে
ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে যখন দেশে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রয়োজন, ঠিক তখনই সময়মতো সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে অবস্থিত দেশের একমাত্র কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা দিন দিন কমছে।
মোট ২৪২ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদনক্ষমতা এরইমধ্যে ৩০ শতাংশ কমে ১৭১ মেগাওয়াটে এসে ঠেকেছে।
মোট পাঁচটি ইউনিটের মধ্যে দুটি ইউনিটের পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে মেরামত (ওভারহল) এবং একটি ইউনিটে আংশিক সংস্কার প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে বারবার দরপত্র আহ্বানের পরও যোগ্য ঠিকাদার না পাওয়া এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে ঝুলে আছে কেন্দ্রটির সংস্কার কাজ।
বন্দর নগরী চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে দেশের একমাত্র জল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হয় ১৯৬২ সালে।
কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তথ্যমতে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪ ও ৫ নম্বর ইউনিটের জেনারেটর বসানোর অবকাঠামোটিতে ফাটল ধরায় (রোটর স্পোর্ক সাপোর্ট ক্র্যাক করেছে) ইউনিট দুটি বাধাহীন চালু রাখা যাচ্ছে না। ফলে মেরামতে প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এছাড়া ৩ নম্বর ইউনিটের টারবাইনসহ যন্ত্রপাতি পুরাতন হওয়ার ফলে চালুর সময়ে শক্তি সঞ্চয় করতেও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
ইউনিট ৩, ৪ এবং ৫ যথাক্রমে ২০১২, ২০১০ ও ২০১১ সাল থেকে মেরামত করা হয়নি। এক একটি ইউনিটের মেয়াদ থাকে ১০ বছর করে। ফলে এগুলোর কর্মক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় কমে গেছে প্ল্যান্টের সামগ্রিক উৎপাদন ক্ষমতা।
প্রকৌশলী এটিএম আবদুজ্জাহের দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় দুটি ইউনিট ওভারহল বা মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একটি বিশেষজ্ঞ দল পরির্দশন করেছে। তারা প্রতিবেদন দেবে। তা অনুযায়ী, কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে।"
প্ল্যান্টের ইউনিট ৪, ৫ এর প্রস্তুতকারক ও স্থাপনকারী প্রতিষ্ঠান জাপানি কোম্পানি তোশিবার একটি বিশেষজ্ঞ দল, চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত ইউনিটগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। পরে তারা জানায়, ইউনিট ৫ অপারেশনের জন্য অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
শীঘ্রই তোশিবা থেকে উভয় ইউনিটের জন্য প্রয়োজনীয় মেরামতের বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন দেওয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এদিকে, ইউনিট ৩ নিয়ে এখনও আশা রয়েছে। প্ল্যান্টের প্রকৌশলীদের বিশ্বাস, খুচরা যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে এই ইউনিটের আয়ু আরও কয়েক বছর বাড়নো যেতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এর সম্পূর্ণ সংস্কার প্রয়োজন বলে জানান তারা।
রক্ষণাবেক্ষণ কাজে বিলম্ব কেন?
২০১৮ সালে ইউনিট দুটি মেরমাতের উদ্দেশ্যে প্রস্তুতকারক ও স্থাপনকারী প্রতিষ্ঠান জাপানি কোম্পানি তোশিবার দ্বারা নিরীক্ষা করা হয়। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে ডিরেক্ট প্রোকিউর্মেন্ট মেথড (ডিপিএম) পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে তোশিবা অংশ নেয়। তবে এই প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতা হয়নি বলে তা বাতিল করা হয়।
পরে একই বছরের ডিসেম্বরে, ২০২১ সালের মে মাসে এবং ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে আরও তিন ধাপে ওপেন প্রোকিউর্মেন্ট মেথড (ডিপিএম) প্রক্রিয়ায় দরপত্র আহবান করা হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক দরপত্রের শর্ত অনুসারে, তিনটি দরপত্রেই তোশিবা কোম্পানির বাংলাদেশের প্রতিনিধি ছাড়া অন্যকোনো প্রতিষ্ঠান সেখানে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়নি। এতে করে বাংলাদেশি অন্যান্য ঠিকাদারদের অভিযোগের ভিত্তিতে এগুলোও বাতিল করা হয়। এরপর থেকে বিষয়টি ঝুলে আছে।
রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ২৫ শতাংশ বাড়ার আশঙ্কা
পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের কর্মকর্তাদের মতে, বিলম্বের কারণে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির প্রভাবে এমনটি ঘটতে পারে বলে সতর্ক করেছেন তারা।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুটি ইউনিট পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে মেরামতের জন্য পিডিবির আমন্ত্রণে ২০১৮ সালের এক পরিদর্শনে নিরীক্ষা করে তোশিবা। ওইসময় তারা পুরোপুরি সংস্কারের ব্যয় ধরেছিল ১০০ কোটি টাকারও বেশি। গত পাঁচ বছরেও সংস্কার না হওয়ায় ব্যয় বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, পাঁচ বছরের ব্যবধানে ডলারের বিনিময় হার এবং যন্ত্রাংশের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ব্যয় ১৩০ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকতে পারে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) সদস্য (উৎপাদন) খন্দকার মোকাম্মেল হোসেন টিবিএসকে বলেন, "সংস্কারের বিষয়ে উদ্যোগ নিতে কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপককে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তারা এ লক্ষ্যে কাজ করছেন। তারা প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষ করে দপ্তরে পাঠালে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"