দেশে মৃত্যুর প্রধান ১০ রোগের মধ্যে অ্যাজমা, শ্বাসতন্ত্রের রোগ অন্যতম: পরিসংখ্যান ব্যুরো
দূষণ, জেনেটিক কারণ, আবহাওয়ার পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে দেশে অ্যাজমা, নিউমোনিয়া, ফুসফুসের সংক্রমণসহ শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন ধরনের রোগ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
শুধু আক্রান্ত নয়, এর পাশাপাশি মৃত্যুও বাড়ছে বলে সতর্ক করেছেন তারা।
গত মার্চে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত 'বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস-২০২৩' প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৩ সালে দেশে যে ১০টি রোগে বেশি মানুষ মারা গেছেন, তার মধ্যে তৃতীয় হলো শ্বাসতন্ত্রের রোগ এবং পঞ্চম হলো অ্যাজমা।
ফলে শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা ও সতর্কতার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
সারাবিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও আজ (৭ মে) পালিত হচ্ছে 'ওয়ার্ল্ড অ্যাজমা ডে' বা বিশ্ব হাঁপানি দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো– 'অ্যাজমা এডুকেশন এমপাওয়ার্স'। এ বছরের প্রতিপাদ্যে অ্যাজমা শিক্ষার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
বাড়ছে অ্যাজমা রোগী
গত বছরের মার্চে প্রকাশিত পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনে শ্বাসতন্ত্রের রোগ নিয়ে উঠে এসেছে উদ্বেগজনক তথ্য। বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস-২০২৩ প্রতিবেদনে দেখা যায়, আলোচিত বছরে প্রতি ১,০০০ মানুষের মধ্যে ০.৫৭ জন মারা গেছেন শ্বাসতন্ত্রের রোগে এবং ০.২৭ জন মারা গেছেন অ্যাজমায় আক্রান্ত হয়ে। যদিও এর আগের বছর শ্বাসতন্ত্রের রোগে মারা গেছেন ০.৫৬ জন ও অ্যাজমায় মারা যান ০.২৮ জন।
শ্বাসতন্ত্রের চিকিৎসার জন্য দেশের একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতাল ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ডিজিজেস অফ দ্য চেস্ট অ্যান্ড হস্পিটাল বা জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের তথ্যেও শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বাড়ার কথা উঠে এসেছে।
২০২৩ সালে বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটে শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ১,৪৬,৪৬৯ জন এবং মারা গেছে ১,০৪৬ জন। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিয়েছেন ৫৫,৭৯৯ জন এবং মারা গেছেন ৪৬০ জন।
এছাড়া, তিন বছর আগে ২০২০ সালে হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নেন ১,১০,৭৭৪ জন এবং সে বছর হাসপাতালটিতে মৃত্যু হয় ৮৭৭ জনের।
চিকিৎসকদের মতে— অপরিকল্পিত নগরায়ন, গ্রামাঞ্চলে শ্বাসতন্ত্রের রোগের পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা না থাকা, অসচেতনাসহ বিভিন্ন কারণে শ্বাসতন্ত্র ও ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদী রোগে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।
দূষণ, খাদ্যে ভেজালের মতো কারণে বাড়ছে অ্যাজমা
গত জানুয়ারি থেকে দেশে অ্যাজমা রোগী আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. সিরাজুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে অ্যাজমা রোগীর সংখ্যা বাড়ার পিছনে অন্যতম কারণ হলো— দূষণ ও খাদ্যে ভেজাল।
"শুধু অ্যাজমা নয় শ্বাসতন্ত্রের অন্যান্য রোগও বাড়ছে। আগে আমাদের আউটডোরে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে প্রতিদিন ৩০০-৫০০ রোগী আসতো, এখন এই সংখ্যা ৮০০ থেকে ১,০০০ এ দাঁড়িয়েছে। গত জানুয়ারি থেকে রোগী অনেক বেড়েছে। শ্বাসতন্ত্রের রোগে সব বয়সীরা আক্রান্ত হচ্ছেন, তবে বয়স্ক ও শিশুদের জটিলতা বেশি," বলেন তিনি।
ডা. সিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, "বাংলাদেশে কত মানুষ অ্যাজমায় ভুগছেন, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৭ শতাংশ মানুষ অ্যাজমায় ভুগছেন, সে হিসেবে বর্তমানে দেশে ১ কোটির বেশি অ্যাজমা রোগী আছে বলে ধারণা করা যায়।"
গ্রামাঞ্চলে অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা
অ্যাজমাসহ শ্বাসতন্ত্রের রোগে গ্রামাঞ্চলে মৃত্যুহার বেশি বলে বিবিএসর তথ্যে উঠে এসেছে। গ্রামে চিকিৎসা সুবিধা পর্যাপ্ত নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম বলেন, "আমাদের হাসপাতালে সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ থেকে রেফার্ড রোগীরা বেশি আছে। এসব রোগী একেবারে ক্রিটিক্যাল (জটিল) অবস্থায় আসে। ঢাকার আশেপাশের রোগীরা শুধু প্রাথমিক পর্যায়ে বা কম জটিলতা নিয়ে আসে।"
কুসংস্কার, এবং সচেতনতার অভাব
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিনের কনসালটেন্ট বা পরামর্শক ডা. রাজীব কুমার সাহা বলেন, "গ্রামে রেসপেরেটরি ডিজিজের (শ্বাসতন্ত্রের রোগ) বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কম। এছাড়া, গ্রামের মানুষের মধ্যে অ্যাজমাসহ বিভিন্ন শ্বাসতন্ত্রের রোগ নিয়ে এক ধরনের স্টিগমা (কুসংস্কার) ও অসচেতনতা আছে। এসব চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদী হয়, কিন্তু গ্রামের মানুষ ধৈর্য ধরে চিকিৎসা কন্টিনিউ করেনা বলে সেখানে মৃত্যুর হার বেশি।"
তিনি আরও বলেন, "অ্যাজমা, শ্বাসকষ্টের রোগী এখন অনেক বাড়ছে। দূষণ বিশেষ করে ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড ডাস্ট পলিউশন, ওয়েদারের ইমব্যালেন্স চেঞ্জ (চরম পর্যায়ের গরম-ঠান্ডা), কোভিডসহ রেসপেরেটরির বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশন বাড়ছে– সে কারণে অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন রেসপেরেটরি ডিজিজও বাড়ছে।"
প্রতিরোধ এবং প্রাথমিক সচেতনতা
ডা. রাজীব কুমার সাহা অ্যাজমা ও শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগের বিষয়ে গণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
তিনি বলেন, ''অ্যাজমা রোগীদের অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে। অ্যাজমার জন্য জেনেটিক কারণ অনেকটা দায়ী, কারো পরিবারে অ্যাজমা থাকলে অন্যদের সতর্ক থাকতে হবে। কারো যদি ডাস্ট বা কোল্ডে অ্যালার্জি (ঠান্ডা বা গরমজনিত অ্যালার্জি) থাকে সেটি যাতে ট্রিগার না করে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।"
অ্যাজমা হলে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগেই চিকিৎসা শুরু করতে হবে, তা না হলে দীর্ঘমেয়াদে জটিলতা বাড়বে বলেও জানান তিনি।