ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জৈব সারের বাণিজ্যিক উৎপাদন বেড়েছে
রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে ফসল উৎপাদনে খরচ কমানোর লক্ষ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কৃষকরা বিভিন্ন জাতের জৈব সারের ব্যবহার বাড়িয়েছেন। এতে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন বাড়ছে বিভিন্ন জাতের জৈব সারের। এর মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে কৃষি উদ্যোক্তা। পাশাপাশি কর্মসংস্থান হচ্ছে বেকার যুবকদের।
বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রতি মাসে ৩৫০ থেকে ৪০০ টন জৈব সার উৎপাদন হচ্ছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ৪০ লাখ টাকা।
স্থানীয় কৃষক ও কৃষি উদ্যোক্তারের উৎপাদিত জৈব সার বিক্রির জন্য সারের দোকানগুলোতে জৈব সার কর্ণারও করে দিয়েছে জেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগ।
জেলাটিতে সবচেয়ে বেশি জৈব সার উৎপাদন হচ্ছে নবীনগরে। এ উপজেলায় কয়েকজন কৃষক ও কৃষি উদ্যোক্তা প্রতি মাসে অন্তত ৬০ টন ভার্মি কমপোস্ট ও ট্রাইকো কমপোস্টসহ বিভিন্ন জৈব সার উৎপাদন করছেন।
প্রতি কেজি জৈব সার কেনাবেচা হয় ১০ থেকে ১২ টাকা দরে, যা রাসায়নিক সারের তুলনায় অর্ধেক। আর জমিতে জৈব সার ব্যবহারের ফলে ফসলের উৎপাদনও ভালো হয় বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
নবীনগর উপজেলার তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা মজির আহমেদ পারভেজ তার বাড়ির পাশে গড়ে তুলেছেন জৈব সারের প্ল্যান্ট। গ্রাম থেকেই জৈব সার তৈরির প্রধান উপকরণ গরুর গোবর ও হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা সংগ্রহ করেন তিনি। তার প্ল্যান্টে কাজ পেয়েছেন স্থানীয় ১০ জন বেকার যুবক।
প্রতি মাসে প্রায় ৩০ টন ভার্মি কমপোস্ট ও ট্রাইকো কমপোস্ট জাতের জৈব সার বাজারজাত করেন পারভেজ। এখন প্রতি মাসে সব খরচ মিটিয়ে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা লাভ হয় তার জৈব সার বিক্রি করে।
পারভেজ বলেন, 'প্রথমে নিজের জমিতে ব্যবহারের জন্য সার উৎপাদন করতাম। পরে অনেক কৃষক আমার কাছ থেকে জৈব সার কেনার আগ্রহ দেখান। ফলে পরবর্তীতে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করি। এছাড়া গ্রামের লোকজন আমার প্ল্যান্টের জন্য গরুর গোবর ও হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা বিক্রির মাধ্যমে তাদেরও বাড়তি আয়ের পথ তৈরি হয়েছে।'
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সবকটি উপজেলাতেই জৈব সার উৎপাদন জনপ্রিয় হচ্ছে। সারের প্ল্যান্টগুলো করা হয়েছে রাস্তার পাশে খোলা জায়গা ও বাড়ির আঙিনাতে। মূলত গরুর গোবর ও হাঁস-মুরগির বিষ্ঠার সঙ্গে আরও কয়েকটি উপকরণের মিশ্রণ পচিয়ে তৈরি হয় ভার্মি কমপোস্ট ও ট্রাইকো কমপোস্টসহ বিভিন্ন জৈব সার। উৎপাদন প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় লাগে ৩৫ দিন।
জৈব সার ব্যবহারের ফলে মাটির গুণাগুণ ঠিক থাকে, যা ফসল উৎপাদনে সহায়ক হয়। ফসলের উৎপাদন ভালো হওয়ায় দিন দিন চাহিদা বাড়ছে জৈব সারের। আর জৈব সারের ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। ফলে বাণিজ্যিক উৎপাদনও বাড়ছে।
বর্তমানে শতাধিক কৃষক ও কৃষি উদ্যোক্তা বাণিজ্যিকভাবে জৈব সার উৎপাদন করছেন। আর এ ব্যবসায় কর্মস্থান হয়েছে কয়েকশ বেকার যুবকের।
মূলত শাকসবজির খেতে জৈব সারের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি করেন কৃষকরা। এছাড়া ধানের জমিতে ব্যবহারেও ভালো ফলন পাচ্ছেন তারা। আর জৈব সার ব্যবহারের মাধ্যমে ফসল উৎপাদনে কৃষকদের খরচ যেমন কমছে, তেমনি রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরতাও কমে আসছে।
নবীনগরের ইব্রাহিমপুর গ্রামের কৃষক কাউসার মিয়া জানান, তিনি বাড়ির আঙিনায় ছোট আকারে জৈব সারের প্ল্যান্ট করেছেন। নিজের শাকসবজি ও ধানি জমিতে ব্যবহারের পাশাপাশি বাজারেও বিক্রি করেন জৈব সার। এই সার ব্যবহারের ফলে তার এখন রাসায়নিক সার কম লাগে জমিতে। এতে ফসল উৎপাদনের খরচ আগের চেয়ে প্রায় অর্ধেক কমেছে বলে জানান তিনি।
কৃষি বিভাগের তথ্য বলছে, প্রতি বছরই জৈব সার উৎপাদন বাড়ছে। আর এখন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই সার উৎপাদন বেশি হচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্ল্যান্টগুলোতে জৈব সারের উৎপাদন হয়েছিল ২ হাজার ১৬০ টন; আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩ হাজার ৭৫০ টন জৈব সার উৎপাদন হয়। আর চলতি অর্থবছরে ৪ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন সার উৎপাদন ও বাজারজাতের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সুশান্ত সাহা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'জৈব সারের বাণিজ্যিক উৎপাদন বাড়ানোর মূল কারণ হলো রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমানো, যার মাধ্যমে ফসল উৎপাদনে কৃষকের খরচ কমবে। এছাড়া জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে পারলে রাসায়নিক সার উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানি গ্যাসেরও চাপ কমবে। সবমিলিয়ে জৈব সার সবদিক থেকেই লাভজনক।'