ঘূর্ণিঝড় রিমাল: জনপদ রক্ষায় ঢাল হয়ে দাঁড়াবে সুন্দরবন
ভৌগোলিকভাবে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার জনপদ ও বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে সুন্দরবনের অবস্থান। বরাবরে মতো এবারও প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব থেকে উপকূল রক্ষায় ঢাল হয়ে দাঁড়াবে এই বনটি।
সুন্দরবন অ্যাকাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, 'সুন্দরবন আমাদের উপকূলকে ঠিক মায়ের মতন বুকে আগলে রাখছে। ঝড়ের সময়ে সে নিজে ক্ষত-বিক্ষত হলেও উপকূলের তেমন ক্ষতি হতে দেয় না।'
আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, গত ১৫ বছরে বেশ কয়েকটি ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস উপকূলে আঘাত হেনেছে। যেমন: ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরে সিডর, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা, ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই কোমেন, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানু ও ২০১৭ সালের ৩০ মে মোরা, ২০১৯ সালের ৪ মে ফণী, ২০১৯ সালের ১০ নভেম্বর বুলবুল, ২০২০ সালের ২০ মে আম্পান, ২০২১ সালের ২৬ মে ইয়াস, ২০২১ সালের ৪ ডিসেম্বর ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ এবং সর্বশেষ ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর উপকূলে আঘাত হানে সিত্রাং। তবে এই ১৫ বছরে সুন্দরবন সব থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে সিডরে।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ বলেন, 'বাংলাদেশর ইতিহাসে প্রলয়ংকারী পাঁচটি ঝড়ের মধ্যে একটি হলো সিডর। এ ঝড়ে বাংলাদেশের খুলনা ও বরিশাল বিভাগ সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর মধ্যে খুলনার দাকোপ উপজেলার কালাবগি এলাকা এবং বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী এলাকা সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আঘাতের সময় সিডরের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার। এর প্রভাবে উপকূলে ১০ থেকে ১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়েছিল।'
তিনি বলেন, 'প্রবল ওই ঝড়টিতে সুন্দরবন বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যদি সুন্দরবন না থাকতো, তবে আমাদের জনপদের যে কি পরিমাণ ক্ষতি হতো, তা কল্পনাও করা যায় না। এছাড়া প্রতিবছর যেসব ঝড় হয়, তাও সুন্দরবনের কারণে দুর্বল হয়ে লোকালয়ে প্রবেশ করে।'
আনোয়ারুল কাদির বলেন, 'ঝড়গুলো ভারতে যে বেগে আঘাত হানে, সেই তুলনায় আমাদের দেশে কম বেগে প্রবেশ করে। ২০২০ সালে আম্পান ভারতে বহু ক্ষয়ক্ষতি করেছিল, আমাদের এখানে তেমন ক্ষতি হয়নি। কারণ সুন্দরবনে বাতাস বাধাপ্রাপ্ত হয়ে অপেক্ষাকৃত কম গতি নিয়ে খুলনাসহ উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে।'
আদিকাল থেকে এই বন আমাদের রক্ষা করে আসছে বলে জানান সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির।
তিনি বলেন, 'বাংলাদেশে ঝড় প্রবেশের মুখেই সুন্দরবনের অবস্থান। এর কারণে ঝড় প্রবেশ করতেই বনে বাধার সম্মুখীন হয়। এতে বনের গাছপালা ও বন্য প্রাণীর ক্ষতি হলেও লোকালয়কে দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে।'
তিনি বলেন, 'রবিবার (২৬ মে) দুপুরের জোয়ারে বনে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উচ্চতায় পানি উঠেছিল। ক্ষতি এড়াতে করমজল বন্যপ্রাণী ও প্রজনন কেন্দ্রের বন্যপ্রাণীদেরও নিরাপদে রাখা হয়েছে। সার্বক্ষণিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রয়োজনীয় আরও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।'
সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) একেএম ইকবাল হোসাইন চৌধুরী বলেন, 'সাতক্ষীরা রেঞ্জের চারটি স্টেশন ও সব টহলফাঁড়িতে অবস্থানরত বনকর্মীদের সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সুন্দরবন ও সাগরে মাছ শিকারে যাওয়া জেলেদের লোকালয়ে ফিরতে পরামর্শ দিয়ে তাদের উদ্ধারে বনকর্মীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।'
বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মোহাম্মদ নূরুল করিম বলেন, '২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা মারাত্মক বিধ্বংসী ক্ষমতা নিয়ে আছড়ে পড়লেও সুন্দরবনে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ফলে অনেক কম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, প্রাণহানিও হয়েছিল আশঙ্কার চেয়ে অনেক কম। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূল ও তৎসংলগ্ন এলাকার মানুষকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষায় দেয়ালের মতো কাজ করে সুন্দরবন। তবে ঝড়ের ফলে সুন্দরবনের মারাত্মক ক্ষতি হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে বনবিভাগের সব কর্মকর্তা ও বনরক্ষীদের ছুটি বাতিল করে তাদের নিরাপদ থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রে বাড়তি সতর্কতা জারি করা হয়েছে।'