ঘূর্ণিঝড় রিমাল: সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ নিয়ে শঙ্কা
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাব ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। সময় যত গড়াচ্ছে, ততই উপকূলের কাছাকাছি চলে আসছে ঘূর্ণিঝড়টি। ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষজনের আতঙ্ক বাড়ছে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন প্রস্তুতি নিয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষজনের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ বলেন, 'রোববার সকাল ৬টা থেকে ঝড়ের অগ্রভাগের অংশের প্রভাব শুরু হয়। ধীরে ধীরে এটি বাড়ছে। পূর্বাভাস অনুযায়ী আজ মধ্যেরাতে ঘূর্ণিঝড়টি সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেহাটের উপকূলে প্রবল বেগে আঘাত হানতে পারে। ঝড়ের প্রভাবে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮ থেকে ১২ ফুটের বেশি জলোচ্ছ্বাসে উপকূল প্লাবিত হতে পারে।'
ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ নিয়ে শঙ্কা
পাউবোর তথ্যমতে, উপকূলীয় তিন জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে মোট দুই হাজার ৬ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ৫১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ।
পাউবোর কর্মকর্তাদের দাবি, ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ অনেকটাই সংস্কার করা হয়েছে। আরও কিছু এলাকা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার বিছট গ্রামের রুহুল আমিন মোড়ল জানান, রোববার সকাল থেকে হালকা বৃষ্টির সাথে দমকা বাতাস বইতে শুরু করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ নিয়ে আতঙ্কে রয়েছে গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ। পাউবোর এই বেড়িবাঁধ ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের কারণে যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে।
স্থানীয়রা জানান, বিভিন্ন স্থানে পাউবোর বেড়িবাঁধটির অবস্থা খুবই দুর্বল। তাই বেড়িবাঁধ রক্ষার জন্য স্থানীয়রাই নিজ উদ্যোগে কাজ শুরু করেছেন।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী এম সালাউদ্দীন বলেন, 'ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে তিন থেকে চার ফুট পানি বেড়েছে। শ্যামনগরকে ঘিরে থাকা উপকূল রক্ষা বাঁধের প্রায় ১২৯ কিলোমিটারের মধ্যে সাত-আটটি পয়েন্টের প্রায় দুই কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ। মাটি ফেলে উচ্চতা বৃদ্ধিসহ জিও ব্যাগ ডাম্পিং করে বাঁধের ভাঙন ও ধস ঠেকানোর কাজ চলছে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মনিরুল ইসলাম জানান, তার বিভাগের আওতাধীন ১৫ এর অধিক পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ঝুকিপূর্ণ রয়েছে। এ মুহূর্তে ৫-৬টি পয়েন্টে কাজ চলছে। পর্যাপ্ত জিও ব্যাগ ও জিও রোল মজুত রয়েছে।
ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় প্রস্তুতি
এদিকে লোকজনের আশ্রয়ের জন্য খুলনায় ৬০৪টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। জেলার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলায় ৫ হাজার ২৮০ জন স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রয়েছেন।
খুলনার জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন জানান, ৬০৪টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে, যাতে পরিস্থিতি অনুযায়ী লোকজন আশ্রয় নিতে পারেন। এসব সাইক্লোন শেল্টারে তিন লাখ ১৫ হাজার ১৮০ জন আশ্রয় নিতে পারবে। এছাড়া তিনটি মুজিব কিল্লায় ৪৩০ জন মানুষ আশ্রয় ও ৫৬০টি গবাদি পশু রাখা যাবে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক হুমায়ুন কবির বলেন, 'ঘূর্ণিঝড় রিমাল মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের স্টেশন ত্যাগ না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।'
তিনি বলেন, 'সাতক্ষীরায় ১৮৭টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রয়েছে। এসব সাইক্লোন শেল্টারে ৪ লাখ ৪৩ হাজার ৫০০ জন মানুষ আশ্রয় নিতে পারবেন। এ ছাড়া জরুরি ত্রাণ কার্যে ব্যবহারের জন্য ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা মজুত রয়েছে। একইসাথে ৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবকসহ স্বাস্থ্য বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, ও কোস্টগার্ড কাজ করবে।'
বাগেরহাট জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ৩৫৯টি আশ্রয়কেন্দ্র, তিন হাজার ৫০৫ জন স্বেচ্ছাসেবক, ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ৬৪৩.৪০০ মেট্রিক টন চাল মজুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহা. খালিদ হোসেন।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স খুলনার উপপরিচালক মামুন মাহমুদ বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের ৩০টি টিম শনিবার সকাল ৬টা থেকে কাজ শুরু করেছে। এর মধ্যে খুলনায় ১৪টি, বাগেরহাটে ১০টি এবং সাতক্ষীরায় ৬টি ফায়ার স্টেশনের টিম কাজ করছে।
সুন্দরবনে বাড়তি সতর্কতা
সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) এ কে এম ইকবাল হোসাইন চৌধুরী বলেন, 'সাতক্ষীরা রেঞ্জের চারটি স্টেশনসহ সকল টহলফাঁড়িতে অবস্থানরত বনকর্মীদের সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সুন্দরবন ও সাগরে মাছ শিকারে যাওয়া জেলেদের লোকালয়ে ফিরতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।'
বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মোহাম্মদ নূরুল করিম জানান, বনবিভাগের সব কর্মকর্তা ও বনরক্ষীদের ছুটি বাতিল করে তাদের নিরাপদ থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রে বাড়তি সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
মোংলা বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ
এদিকে রোববার সকালে ঘূর্ণিঝড় রিমাল নিয়ে দেওয়া ১০ নম্বর বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে আবহাওয়া অধিদপ্তর পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেখাতে বলেছে।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল শাহীন রহমান জানান, এই মুহূর্তে মোংলা বন্দরের হারবাড়িয়ায় চারটি জাহাজ, বেসক্রিক এরিয়ায় একটি ও জেটিতে দুটি জাহাজসহ মোট ৬টি বিদেশি জাহাজ রয়েছে। ঝড় থেমে না যাওয়া পর্যন্ত মোংলা বন্দরের সকল প্রকার অপারেশন কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।
গত ১৫ বছরে উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানা ঝড়
আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, গত ১৫ বছরে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঝড় উপকূলে আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরে সিডর, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা, ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই কোমেন, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানু, ২০১৭ সালের ৩০ মে মোরা, ২০১৯ সালের ৪ মে ফণী, ১০ নভেম্বর বুলবুল, ২০২০ সালের ২০ মে আম্পান, ২০২১ সালের ২৬ মে ইয়াস, ৪ ডিসেম্বর ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ ও সর্বশেষ ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর উপকূলে আঘাত হানে সিত্রাং। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সিডরের আঘাতে।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ বলেন, 'বাংলাদেশর ইতিহাসে পাঁচটি বড় ঝড়ের মধ্যে একটি সিডর। এ ঝড়ে বাংলাদেশের খুলনা ও বরিশাল বিভাগ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সুন্দরবনেরও বেশ ক্ষতি হয়েছিল।'
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, 'বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ অঞ্চলে প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে।'