আরেকটি দিন, আরেকটি ত্রুটি: যাত্রীরা কি মেট্রোরেল থেকে আস্থা হারাচ্ছেন?
ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে শুরু হওয়া বৃষ্টিতে আজ সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। তাই যাত্রীরা ভেবেছিলেন তারা হয়ত মেট্রোরেলে নির্বিঘ্নে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন। কিন্তু না, এমনটা হয়নি। সেখানেও বিপত্তি। আজ সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সকাল ১১টা পর্যন্ত বন্ধ ছিল মেট্রোরেল পরিষেবা। এতে বহু যাত্রী ভোগান্তিতে পড়েন।
বলা যায়, যাত্রীদের যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল, ঠিক তখনই বন্ধ ছিল মেট্রোরেল পরিষেবা।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে গতকাল রবিবার (২৬ মে) রাত থেকেই রাজধানীতে বৃষ্টি শুরু হয়। আজ বিকালে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্তও বৃষ্টি হচ্ছিল। আর এতে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
ফার্মগেট মেট্রোরেল স্টেশনে আজমিন হক নামে এক যাত্রীর সঙ্গে কথা হয়। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে তিনি ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
আজমিন হক বলেন, 'আমাকে সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে অফিসে পৌঁছাতে হবে। ভিড় এড়িয়ে যেন নির্বিঘ্নে অফিসে পৌঁছাতে পারি, সেজন্য সকাল সাড়ে ৭টায় স্টেশনে এসেছি। এখন প্রায় ১০টা বাজে। অথচ ট্রেনের দেখা নেই।'
আজমিন হক মেট্রোরেলের নিয়মিত যাত্রী। ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় আজ সকালে তার মতো আরও অনেক যাত্রীই ভোগান্তিতে পড়েন।
বেসরকারি চাকরিজীবী জাহিদ হোসেন নামে এক যাত্রী জানান, তিনি সকাল ১০টার মধ্যেই অফিসে পৌঁছাতে পারবেন বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু মেট্রোরেলই বন্ধ ছিল সকাল ১১টা পর্যন্ত।
তিনি বলেন, 'আপনি আকাশের দিকে তাকিয়ে আবহাওয়ার বিষয়ে অনুমান করতে পারেন এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা সাজাতে পারেন। কিন্তু মেট্রোরেলের ক্ষেত্রে কোনো অনুমান করা যায় না।
এ বিষয়ে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) জনসংযোগ কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম ভুঁইয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ক্যাটেনারি লাইনে বিদ্যুৎ সরবরাহে সমস্যা হয়েছিল। তবে যাত্রীদের দুর্ভোগ কমাতে এই সময়ে একটি লাইনে কয়েকটি ট্রেন চালু রাখা হয়েছিল।'
রাজধানীতে মানুষের চলাচলের ক্ষেত্রে ব্যাপক স্বস্তি এনে দিয়েছে মেট্রোরেল। কিন্তু দিন দিন এর প্রতি মানুষের আস্থা হারাচ্ছে।
আজ সোমবার সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ১১টা পর্যন্ত বন্ধ ছিল ট্রেন চলাচল। তবে আজই প্রথমবার নয়, এর আগেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়।
মাত্র দুদিন আগেই 'যান্ত্রিক ত্রুটি'র কারণে প্রায় দেড় ঘণ্টা বন্ধ ছিল মেট্রো চলাচল। আজও সেই একই কারণে বন্ধ ছিল মেট্রোরেল পরিষেবা।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে এই 'যান্ত্রিক ত্রুটি'র কারণেই মাঝপথে ট্রেনের ভেতরে যাত্রীরা আটকা পড়েছিলেন।
গত বছরের আগস্টে কয়েক ঘণ্টার জন্য ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছিল। এবারও সেই ওভারহেড ক্যাটেনারি সিস্টেমে সমস্যা, অর্থাৎ যান্ত্রিক ত্রুটি।
ঘন ঘন যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে যাত্রীরাও এখন মেট্রোরেলে ভ্রমণের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হচ্ছেন।
শান্তা রহমান পেশায় শিক্ষক। তার কর্মস্থল উত্তরায়। তিনি প্রতিদিন আগারগাঁও থেকে কর্মস্থলে যেতে মেট্রোরেল ব্যবহার করেন।
তিনি বলেন, 'আমরা বুঝি এটি একটি নতুন প্রযুক্তি এবং সমস্যা হবেই। তবে মেট্রোরেল যে বন্ধ রয়েছে, সেটি মানুষের জানার একটি উপায় থাকা উচিত। তারা (কর্তৃপক্ষ) ফেসবুকে এ বিষয়ে পোস্ট করে, কিংবা অন্তত কোথাও নোটিশ প্রদর্শন করে জানাতে পারেন। সর্বোপরি এটি ডিজিটাল বাংলাদেশ।'
এদিকে বিশেষজ্ঞরা মেট্রোরেলের ওভারহেড ক্যাটেনারি সিস্টেম (লোকোমোটিভগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহের একটি পদ্ধতি) নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন।
এর আগে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শামসুল হক টিবিএসকে বলেছিলেন, 'কয়েক শ বছরের পুরনো ওভারহেড ক্যাটেনারি প্রযুক্তি ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরের জন্য মোটেই উপযুক্ত নয়। সাম্প্রতিক সময়ে ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বে আর কোথাও এ প্রযুক্তির ব্যবহার নেই।'
সমস্যা এড়াতে এবং ট্রেনগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে বেশিরভাগ উন্নত দেশ ওভারহেড ক্যাটেনারি সিস্টেম পরিহার করেছে এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের নতুন পদ্ধতি গ্রহণ করেছে।
যেমন- ২০১৫ সালে পাকিস্তানের লাহোরে মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ২০২০ সাল থেকে এটির চলাচল শুরু হয়। ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এ রেল পথে ওভারহেড ক্যাটেনারি সিস্টেমের বদলে 'থার্ড-লাইন টেকনোলজি' ব্যবহার করা হয়েছে।
অধ্যাপক ডা. শামসুল হক জানান, থার্ড-লাইন টেকনোলজি সিস্টেমে ওভারহেড ক্যাটেনারি লাইন স্থাপন না করে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য মেট্রো রেল লাইনের সমান্তরালে একটি তৃতীয় লাইন নির্মাণ করা হয়।
তিনি বলেন, 'মেট্রোরেলের পরিকল্পনা তৈরির সময় ওভারহেড ক্যাটেনারি সিস্টেম প্রযুক্তি নিয়ে আমি আপত্তি জানিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে দুই পাশের উঁচু ভবন থেকে অনেক কিছুই তারের ওপর পড়ে যেতে পারে। ঝড়ের সময় পলিথিনসহ অনেক কিছুই উড়ে বিদ্যুতের লাইনে পড়তে পারে। এমন এক শহরে ওভারহেড ক্যাটেনারি সিস্টেম মেট্রোরেলের জন্য বহু সমস্যা তৈরি করতে পারে।'
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রেলওয়ের বৈদ্যুতিক খুঁটিতে একটি ঘুড়ি আটকে যাওয়ায় মেট্রোরেল পরিষেবা বিঘ্নিত হয়েছিল।
আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, যখন এসব সমস্যা দেখা দেয়, তখন কেউ চাপ না দেওয়া পর্যন্ত মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ চুপচাপ বসে থাকে।
মেট্রোরেলের কারণে রাজধানীতে মানুষের যাতায়াতে অনেক সুবিধা হয়েছে ঠিকই, তবে মাঝেমধ্যেই ট্রেন চলাচল বন্ধ হওয়ায় যাত্রীদের দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের ভোগান্তির বিষয়টিতে গুরুত্ব দিলে মেট্রোরেল পরিষেবা নিয়ে আর অভিযোগ আর থাকবে না বলে মনে করেন যাত্রীরা।