বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটি রেল স্টেশন: ৩৮ ট্রেনের মধ্যে থামছে মাত্র একটি, ভোগান্তিতে হাজারো যাত্রী
প্রায় ছয় বছর আগে, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে মহাসমারহে উদ্বোধন করা বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটি রেলওয়ে স্টেশনটি এখনও অনেকটা অকেজোই পড়ে আছে।
উত্তরবঙ্গের সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ আশেপাশের এলাকার যোগাযোগ সহজ করতে নির্মিত হয় এ স্টেশন। কিন্তু শুধুমাত্র ট্রেনের যাত্রাবিরতি না থাকায় স্টেশনটি এখন আর কোনো কাজেই আসছে না।
বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটি থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরে নির্মিত স্টেশনটি দেশের আধুনিক ও বিলাসবহুল রেলওয়ে স্টেশনগুলোর মধ্যে একটি। এতে রয়েছে একক প্ল্যাটফর্ম, একটি লুপ লাইন ও আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থার মতো সুবিধাসমূহ।
৪৮ কোটি ৫৯ লাখ ২৮ হাজার ৭৯৪ টাকা ব্যয়ে নির্মিত স্টেশনটি ২০১৮ সালের পহেলা নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন। এরপরে ৬ বছর পেরিয়ে গেলেও স্টেশনটি মানুষের কোনো উপকারে আসছে না।
স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি পোশাক শিল্পের পেশাজীবীদের বৃহৎ অংশই আসেন উত্তরবঙ্গ থেকে। রাজধানীর হেমায়েতপুর, সাভার, নবীনগর, ধামরাই, কালামপুর, নবীনগর, পল্লীবিদ্যুৎ, বাইপাইল (পশ্চিম আশুলিয়া), রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা, জিরানী, কবিরপুর, গাজীপুরের টঙ্গী থেকে শুরু করে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের দুইপাশের ভোগড়া, কোনাবাড়ী, কাশিমপুর, সফিপুর, চন্দ্রা এলাকায় বাস করছেন লাখ লাখ শ্রমিক।
উত্তরবঙ্গের ২৩ জেলার ৬ কোটি মানুষের প্রায় প্রতিটি পরিবারের অন্তত একজন করে কর্মসূত্রে এসব এলাকায় বাস করেন। এসব এলাকার বাসিন্দাদের যাতায়াতের একমাত্র পথ ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক। সকলেই জানান, কালিয়াকৈরের চন্দ্রা হলো একমাত্র প্রবেশ পথ। এ পথ ধরেই উত্তরবঙ্গের ২৩ জেলার মানুষ রাজধানীতে নানান প্রয়োজনে আসা-যাওয়া করেন। অন্য এলাকার মানুষ এ পথ দিয়েই উত্তরবঙ্গে যাতায়াত করেন।
স্থানীয়দের মতে, চন্দ্রা থেকে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি রেলস্টেশনের দূরত্ব মাত্র আধা কিলোমিটার। ফলে সড়ক পথের যানজট, যাত্রী ভোগান্তী ও যাত্রার সময় কমানোতে এই স্টেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ, তুলনামূলক আরামদায়ক ও সাশ্রয়ী হওয়ায় এক্ষেত্রে বাংলাদেশ রেলওয়ে উত্তরবঙ্গের ২৩ জেলার মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছে। উভয়মুখী গন্তব্যে সকলের প্রথম পছন্দ রেল। বিপুল সম্ভাবনাময় স্টেশনটি দেশের উত্তরবঙ্গের সাথে যোগাযোগের একটি কমিউনিকেশন হাবে রূপান্তরিত হতে পারত। কিন্তু শুধু ট্রেন না থামার কারণে জাতির পিতার নামের স্টেশনটি এখন অযত্ন-অবহেলায় নিঃসঙ্গ এক স্থাপনায় পরিণত হয়েছে।
প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ হাজার যাত্রীসেবার লক্ষ্য নিয়ে স্টেশনটির যাত্রা শুরু হলেও ৬ বছরে পূরণ হয়নি সে প্রত্যাশা।
গত বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দেখা যায়, কালিয়াকৈর বাজারের ব্যবসায়ী কবির হোসেন সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে এই স্টেশন থেকে জয়দেবপুর যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, "এতবড় একটি স্টেশন, অথচ ট্রেন থামে না। যদি আরও অধিক সংখ্যক ট্রেন এখানে দাঁড়াতো, তাহলে কালিয়াকৈরবাসীর অনেক উপকারে হতো। আমরা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের যানজটের ভোগান্তি এড়িয়ে দ্রুত গন্তব্যে যাতায়াত করতে পারতাম।"
স্থানীয় বাসিন্দা ও ছাত্র সুমন খান একইদিন সকাল সোয়া ৯টায় স্টেশনে আসেন, সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেসে করে ঢাকা যাওয়ার জন্য। তবে ১০:৪০ মিনিটেও ট্রেন আসেনি। তিনি অভিযোগ করেন, "স্টেশনে সবকিছুই ঠিকঠাক আছে, শুধু ট্রেন নেই। এখানে নিয়মিত ট্রেনের যাত্রা বিরতি হলে কালিয়াকৈরবাসীর অনেক সুবিধা হতো।"
সকাল পৌনে ১১টার দিকে সুনশান স্টেশনে দেখা গেল চাঞ্চল্য। অর্ধ শতাধিক যাত্রী এসে হাজির। দেখা গেল শসা, পানি, চিপ্স হাতে কয়েকজন হকারকেও। স্টেশন মাস্টারসহ অন্য স্টাফরাও প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ালেন। জানা গেল, কিছুক্ষণের মধ্যে ঢাকা ছেড়ে আসা বুড়িমারী এক্সপ্রেস ট্রেনটি এই স্টেশনে যাত্রাবিরতি দেবে। টাঙ্গাইলের পর সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি সিঙ্গেল লাইনে ঢুকে পড়ার কারণে আর কোনো দ্বিতীয় লাইন না থাকায় বাধ্য হয়ে বুড়িমারী এক্সপ্রেস এখানে দাঁড়াবে।
কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রেনটি স্টেশনের ৩নং প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ালো, তবে এটি কোনো শিডিউলড যাত্রা বিরতী না হওয়ায় স্টেশন থেকে কোনো যাত্রী ওঠেনি বা নামেনি।
এর কিছুক্ষণ পর স্টেশনের ১ নং প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ালো সিরাজগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা এই স্টেশনের একমাত্র সঙ্গী সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস। ট্রেন থেকে ৭০/৮০ যাত্রী নামলেন।
এ সময় অনেকের সাথে নামলেন চন্দ্রা এলাকায় একটি কারখানার ব্যবস্থাপক মাহফুজ, তার বাড়ি সিরাজগঞ্জ। টিবিএসকে তিনি বলেন, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের যাত্রী-যানবাহনের চাপ কমাতে ও যানজট সমস্যার সহজ ও সুন্দর সমাধান হতে পারে এ স্টেশনে বিভিন্ন আন্তঃনগর ট্রেনের কয়েক মাত্র মিনিটের যাত্রাবিরতি। এমনটি হলে রেল হবে আরও লাভজনক ও জনপ্রিয়।
রেল সূত্রে জানা যায়, এই রেল রুটে বর্তমানে ৩৮টি ট্রেন আসা-যাওয়া করে। এর মধ্যে দুটি মাত্র ট্রেন— সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ও টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেন দুটি এখানে যাত্রা বিরতি করে।
সূত্র আরও জানায়, এই রুটের চিত্রা এক্সপ্রেস, সিল্কসিটি, পদ্মা এক্সপ্রেস, ধুমকেতু এক্সপ্রেস, রংপুর এক্সপ্রেস, বুড়িমারী এক্সপ্রেস, লালমনি এক্সপ্রেস, পঞ্চগড় এক্সপ্রেস, দ্রুতযান, নীলসাগর এক্সপ্রেস, চিলাহাটি এক্সপ্রেস, কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস, বনলতা এক্সপ্রেসসহ অনেক জনপ্রিয় আন্তঃনগর ট্রেন স্টেশনটির ওপর দিয়ে গেলেও তাদের দাঁড়ানোর অনুমতি নেই। এই রেল রুটে লোকাল ট্রেন ৯৯ আপ, ৫ ডাউন চাঁপাইনবাবগঞ্জ-ঢাকা, ঢাকা-চাঁপাইনবাবগঞ্জ চলাচল করে। কিন্তু লোকাল এ ট্রেনটিও এখানে দাঁড়ায় না।
বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি রেলস্টেশনের স্টেশন মাস্টার মো. খায়রুল ইসলাম বলেন, "এই রুট দিয়ে চলাচল করে ২০ জোড়া (৪০টি) ট্রেন। কিন্তু বিশাল এই স্টেশনে স্টপেজ মাত্র দুটি লোকাল ট্রেনের। এগুলোর একটি টাঙ্গাইল কমিউটার, অপরটি সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস।"
"এরমধ্যে দুর্ঘটনার পর থেকে টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেন বন্ধ রয়েছে। আর দুই ট্রেনের জন্য বরাদ্দ টিকিটের সংখ্যা ৬০। এই স্টেশনের মাসিক খরচ অন্তত ৫ লাখ টাকার কাছাকাছি। কিন্তু সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বও এখান থেকে আয় হয় মাত্র কয়েক হাজার টাকা।"
ট্রেনের যাত্রাবিরতি বাড়লে, এখান থেকে জয়দেবপুর স্টেশনের চেয়ে বেশি রাজস্ব আহরণ করা সম্ভব হবে বলে জানান তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কালিয়াকৈরের একটি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বলেন, "জাতির পিতার নামে যে স্টেশনের নাম রাখা হয়েছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে স্টেশন উদ্বোধন করেছেন, সেখানে ৬ বছরেও ট্রেন থামানোর ব্যবস্থা হয়নি, স্টেশনটি খালি পড়ে থাকে, এটি আমাদের জন্য খুবই বেদনার। আশা করি, কর্তৃপক্ষ এখানে ট্রেন থামানোর ব্যবস্থা করবে।"
এ বিষয়ে কালিয়াকৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাওসার আহমেদ বলেন, "বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি রেলওয়ে স্টেশনটি খুবই সুন্দর একটি স্টেশন। যোগাযোগের ক্ষেত্রে এর গুরুত্বও বেশি। কিন্তু উত্তরবঙ্গের কোনো রেলেরই এই স্টেশনে স্টপেজ রাখা হয়নি। এ কারণে অনেক যাত্রী উল্টোপথে কমলাপুর/বিমানবন্দর/জয়দেবপুর স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ভ্রমণ করেন।"
"এতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বাড়তি যানজট হয়। যানজটে পড়ে মানুষের ভোগান্তী বাড়ে, ক্ষতির পরিমাণও বাড়ে। এখানে ট্রেনগুলো থামলে— স্থানীয় বাসিন্দা, এখানে কাজ করা বিপুল সংখ্যক শ্রমিক ভাই-বোনদের অনেক উপকার হবে," বলেন তিনি।
এ বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সংসদ সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, "গাজীপুরের চন্দ্রা যোগাযোগ ব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম এলাকা। মহাসড়কের যানবাহন ও যাত্রী চাপ কমাতে স্থানীয় মানুষের এবং অত্র এলাকায় কর্মসূত্রে বসবাসকারী মানুষের যোগাযোগের সুবিধার্থে এ স্টেশনে সব ট্রেন থামা উচিত।"
"আমি আশা করি, রেল কর্তৃপক্ষ সবকিছু বিবেচনা করে এ স্টেশনে ট্রেন থামানোর ব্যবস্থা করবে। এটা আমাদের দীর্ঘদিনে দাবি," যোগ করেন মন্ত্রী।