বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে জলাবদ্ধতা নিরসনের হাজার কোটি টাকা ব্যয়, ডুবছে সিলেট
জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে যেন কিছুতেই নিস্তার পাচ্ছে না সিলেটবাসী। অথচ এই খাতে গত ১৪ বছরে প্রায় ১,১০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। এরপরেও ভারী বৃষ্টি হলে তলিয়ে যাচ্ছে নগর।
শনিবার রাতে মাত্র তিন ঘণ্টায় রেকর্ড ২২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় সিলেটে। এতেই এক সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো ভয়াবহ বন্যার মুখে পড়লো সিলেট। রাত ৯টায় শুরু হয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত চলা বৃষ্টিতে ব্যাপক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় নগরজুড়ে।
পানি ঢুকে পড়ে বাসাবাড়ি ও দোকানপাটে। এমনকি, ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কার্যালয়সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়ও পানি ঢুকে পড়ে।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, সিলেটে সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ৩ মিলিমিটার, এরপর রাত ৯টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ২২০ মিমি বৃষ্টি হয়েছেন। এরপর রোববার সকাল ৬টা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ৩৪ মিলিমিটার। বৃষ্টি থামার পর যদিও আস্তে আস্তে পানি কমতে শুরু করেছে।
সিলেট সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, জলাবদ্ধতা নিরসনে গত ১৪ বছরে ১ হাজার ৭৮ কোটি টাকার কাজ করেছে কর্তৃপক্ষ। এর বাইরে চলতি বছর তিনটি ড্রেন নির্মাণে খরচ হয়েছে সাড়ে ৫ কোটি টাকা। পাশাপাশি আরও ৫৫ কোটি টাকার কাজ চলছে।
সম্প্রতি ৩০০ কোটি টাকার আরও কয়েকটি প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে।
এছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড সুরমা নদীর নগর অংশ খননে গত দেড় বছরে খরচ করছে ৫৫ কোটি টাকা।
এতো টাকা ব্যয়ের পরেও কেন ভারী বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যাচ্ছে সিলেট— এমন প্রশ্ন উঠছে। প্রশ্ন উঠেছে প্রকল্পগুলোর স্বচ্ছতা আর পরিকল্পনা নিয়েও।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেট এলাকার সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, "সঠিকভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে নগরবাসীকে এই দুর্ভোগ পোহাতে হতো না। সরকার বরাদ্দ দিলেও প্রকল্প বাস্তবায়ন যথাযথভাবে হয়নি। এসব টাকায় কী কী কাজ হয়েছে, তা নগরবাসীর কাছে প্রকাশ করা দরকার।"
তবে বাস্তবায়িত প্রকল্পের অনেক সুফল মিলছে দাবি করে সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, "এখন আর আগের মতো জলাবদ্ধতা হয় না। তাছাড়া পানি জমলেও বৃষ্টি থামলে তা দ্রুতই নেমে যায়।"
রোব ও সোমবারের জলাবদ্ধতাকে ব্যতিক্রম উল্লেখ করে তিনি বলেন, "এটি হয়েছে বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে। বন্যায় সবগুলো ড্রেন ও ছড়া আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে। নদীও পানিতে টুইটুম্বুর। তাই বৃষ্টির পানি জমে গেছে।"
"আমরা ড্রেন ও ছড়া পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করেছি। এক্ষেত্রে নগরব্সাীকেও সচেতন হতে হবে। ময়লা-আবর্জনা যেখানে-সেখানে না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে, ড্রেনে কিছুতেই ময়লা-আবর্জনা ফেলা যাবে না।"
"জলাবদ্ধতা থেকে পুরোপুরি মুক্তি পেতে সুরমা নদী খনন ও শহররক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা জরুরি। এ নিয়ে সিটি করপোরেশন কাজ করছে," যোগ করেন তিনি।
তবে কর্তৃপক্ষের এসব কথা মানতে নারাজ নগরবাসী।
নগরের শিবগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা রিপন চৌধুরী বলেন, "রোববার ও সোমবার সিলেটে যে পানি হয়েছে, এটি বন্যা নয়; এটি জলাবদ্ধতা।"
"নদী ভরাট হওয়ার কারণে পানি জমলে সকালের পানি দুপুরে কমে যায় কীভাবে? এই নদী দিয়েই তো পানি নেমেছে। আসলে ড্রেন ভরাট হয়ে যাওয়া, সড়কের পানি নামার রাস্তা না থাকার কারণে এমন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে," বলেন তিনি।
সোমবার সকালে সিলেট নগর ঘুরে দেখা যায়— নগরের উপশহর, তেরররন, যতরপুর, মেন্দিবাগ, জামতলা, তালতলা, শেখঘাট, কলাপাড়া মজুমদার পাড়া লালদীঘির পাড়, সোবহানী ঘাট, মির্জাজাঙ্গাল, কদমতলী, কালিঘাট, শেখঘাটসহ অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে।
তবে মঙ্গলবার বেশিরভাগ এলাকা থেকে পানি নেমে যায়। যদিও উপশহর, তেররতন, তালতলাসহ কিছু এলাকায় এখনও পানি জমে আছে।
পরিবেশবাদী সংগঠন ভূমিসন্তান বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়ক আশরাফুল কবির জলাবদ্ধতার জন্য অপরিকল্পিত উন্নয়নকে দায়ী করে বলেন, "জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যাপক কাজ করা হয়েছে। বছরের পর বছর নগরজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি করা হলেও এগুলো হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে।"
তিনি বলেন, "নগরের ছড়া খাল ও দিঘি ভরাট করে ফেলা হয়েছে। বড় বড় ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু বৃষ্টির পানি সড়ক থেকে ড্রেনে নামার মতো যথেষ্ট জায়গা তৈরি করা হয়নি। পানি নামার জন্য ড্রেনে কিছু গর্ত রাখা হলেও তা ময়লা আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে। এ কারণেই বৃষ্টির পানি দ্রুত থামতে পারছে না।"
সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) সূত্রে জানা গেছে, সিলেট নগরে ছোট-বড় মিলিয়ে ১১টি ছড়া প্রবাহমান। এসব ছড়ার ১৬টি শাখা ছড়াও রয়েছে। এসব ছড়া-খাল সুরমা নদীতে গিয়ে মিশেছে। ছড়া-খালগুলোর দৈর্ঘ্য প্রায় ১১০ কিলোমিটার। এর বাইরে নালা-নর্দমা আছে ৯৭০ কিলোমিটার। নালা-নর্দমায় প্রায় সাড়ে ৬০০ কিলোমিটার পাকা ড্রেন আছে।