অবৈধ উপায়ে জন্মসনদ নিয়েছে ১০২ রোহিঙ্গা: পুলিশ
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনসহ (ডিএনসিসি) দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১০২ জন রোহিঙ্গা তাদের পরিচয় গোপন করে জন্ম নিবন্ধন নিয়েছেন। এদের মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটির বিভিন্ন জোনের অফিস থেকে ৪৯ জন এই সনদ নিয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
গত ২৬ মে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বাংলাদেশ পুলিশের পাসপোর্ট শাখার স্পেশাল ব্রাঞ্চ এসব জন্ম নিবন্ধন বাতিলের জন্য অনুরোধ করে।
জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার জেনারেল সামিউল ইসলাম রাহাদ টিবিএসকে বলেন, "পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা জন্ম নিবন্ধন নম্বরগুলো স্থগিত করেছি। নিবন্ধনের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের তৎক্ষণাৎ ডাকা হয়েছে। আমাদের আইসিটি বিভাগ এটি নিয়ে কাজ করছে।"
জন্ম সনদ পাওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৭৭ জনের তালিকা পেয়েছে টিবিএস। এরমধ্যে ঢাকা উত্তর সিটির ৪২টি, বদরগঞ্জের দামোদরপুর ইউনিয়ন পরিষদের ২৩টি, রংপুরের ২৩টি, বাগেরহাটের গোতাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ ১১টি এবং বরিশাল সদর উপজেলার চরকাউয়া ইউনিয়ন পরিষদের দেওয়া একটি সনদপত্র পাওয়া গেছে।
এছাড়া, বানারীপাড়া উপজেলায় এক রোহিঙ্গাকে জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরু-আল-কায়েস টিবিএসকে বলেন, "আমরা যে নাম্বারগুলো পেয়েছি, সেগুলো পুঙ্খনাপুঙ্খভাবে চেক করেছি। আমাদের কোনো জোন থেকেই সেগুলো রেজিস্ট্রেশন হয়নি। এগুলো হয়তো বাইরে কোথাও থেকে তৈরি করা হয়েছে। আমরা সোমবার রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে এর ব্যাখ্যা পাঠিয়েছি। সেখানে আমরা উল্লেখ করেছি এ জন্মনিবন্ধনের নাম্বারগুলো অবৈধ এবং সঠিক নয়।"
২৬ মে বাংলাদেশ পুলিশের পাসপোর্ট শাখার স্পেশাল ব্রাঞ্চের পাঠানো চিঠিতে আরও বলা হয়, 'সংযুক্ত তালিকায় বর্ণিত ১০২ জন জন্ম নিবন্ধনধারী ব্যক্তি অবৈধ উপায়ে দেশের বিভিন্ন স্থান হতে জন্ম নিবন্ধন গ্রহণ করে বাংলাদেশী পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছেন।'
'গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাদের পাসপোর্টের বিষয়ে অধিকতর অনুসন্ধান করা হয়। অধিকতর অনুসন্ধানে তালিকায় বর্ণিত ব্যক্তিগণের পাসপোর্টে উল্লিখিত স্থায়ী ঠিকানা সঠিক পাওয়া যায় নাই।'
চিঠিতে আরও বলা হয়, 'গোয়েন্দা তথ্য ও অধিকতর অনুসন্ধান প্রতিবেদন পর্যালোচনায় জানা যায় যে, উল্লিখিত ব্যক্তিগণ তাদের নামের পার্শ্বে বর্ণিত বিভিন্ন স্থান হতে দালাল চক্র, অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ইত্যাদি ব্যক্তিগণের সহায়তায় প্রতারণামূলকভাবে বাংলাদেশী জন্ম নিবন্ধন সংগ্রহ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে তালিকায় বর্ণিত জন্ম নিবন্ধনধারী ব্যক্তিগণ রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ভুক্ত মিয়ানমারের নাগরিক।'
চিঠিতে তালিকায় বর্ণিত রোহিঙ্গাদের নামে ইস্যুকৃত জন্ম নিবন্ধন বাতিলসহ মিয়ানমারের নাগরিকগণকে (রোহিঙ্গা) অবৈধ উপায়ে নিবন্ধন প্রদান করার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যেও বলা হয়েছে।
এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ জুন জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের দপ্তর থেকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি পাঠিয়ে ৫ কর্ম দিবসের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হয়ে ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হয়।
ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বরাবর পাঠানো চিঠিতে পুলিশের চিঠির বিষয় উল্লেখ করে বলা হয়, 'আপনার আওতাধীন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন হতে প্রায় ৪৯ জন রোহিঙ্গা নাগরিকের জন্ম নিবন্ধন সম্পন্ন করা হয়েছে। উল্লেখ্য, আইন বর্হিভূতভাবে নিবন্ধনকৃত ৪৯ জন রোহিঙ্গা নাগরিকের জন্ম সনদ ইতোমধ্যে বিডিআরআইএস সিস্টেম হতে স্থগিত করা হয়েছে।'
পরে গত রোববার (৯ জুন) ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন থেকে ঢাকা উত্তরের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও সকল আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাকে ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।
ঢাকা উত্তরের সচিব মোহাম্মদ মাসুদ আলম সিদ্দিক স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, 'উপর্যুক্ত বিষয় ও সূত্রোক্ত পত্রের মর্মানুযায়ী বর্ণিত রোহিঙ্গা নাগরিকের জন্ম সনদ প্রদানের সময় দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা/কর্মচারীদের যথা সময়ে যথাস্থানে স্ব-শরীরে উপস্থিত হয়ে ব্যাখা প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করণের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।'
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, "এমন সংবাদ খুবই উদ্বেগজনক। দেশে যে ব্যাপকহারে দুর্নীতি ও অনিয়ম ঘটেছে, এটি তারই চিত্র। জন্ম নিবন্ধন নিয়ে এটি প্রথম অনিয়ম নয়, এর আগেও হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "এমন কর্মকাণ্ডের সাথে যারা জড়িত, তাদেরকে চিহ্নিত করে অতিদ্রুত আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা এমন অসদুপায়ে জন্ম নিবন্ধন পেয়েছেন, তারা যতটুকু দায়ী, তাদের থেকেও বেশি দায়ী হচ্ছেন এই কর্মকাণ্ডে জড়িত সংঘবদ্ধ চক্র ও কর্মকর্তারা। আমাদের এমন কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক মণ্ডলে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এসব কারণেই বাংলাদেশের পাসপোর্ট দেখলে বিদেশিরা অন্যভাবে নেয়।"
ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, "দেশে একটি চক্র আছে যারা রোহিঙ্গাদের এভাবে ফেসিলেটেড করে। যারা অসদুপায়ে এসব করে তারা দেশে থাকুক কিংবা বিদেশে যাক– তারা যদি অনয়িম, বেআইনী কিছুর সঙ্গে জড়িত হয়– তখন সব দায় বাংলাদেশের উপরেই আসবে।"