রক্তক্ষয়ী অবরোধের মধ্য দিয়ে পশ্চিম সীমান্তের দখল হারালো মিয়ানমারের সামরিক জান্তা
বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত সামরিক জান্তার শেষ ঘাঁটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাধ্যমে দখল করে নিয়েছে বিদ্রোহী আরাকান আর্মি।
আরাকান আর্মির (এএ) প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, বর্ডার গার্ড পুলিশ ব্যারাক ৫-এ (বিজিপি৫) অনেকেই (আরাকান আর্মি) খালি পায়ে বিভিন্ন অস্ত্র দিয়ে হামলা চালাচ্ছেন আর তাদের ওপর দিয়ে উড়ছে সামরিক বিমান।
এএ-এর এক সদস্য বলেন, "তারা (বিজিপি) ঘাঁটির চারপাশে গভীর খোঁড়া মাটিতে কাঁটা বসিয়েছিল। বাঙ্কার ও সুরক্ষিত ভবন ছিল। তারা এক হাজারেরও বেশি মাইন পুঁতে রেখেছিল। অনেক যোদ্ধা তাদের জীবন বা অঙ্গ হারিয়েছেন সেখানে পৌঁছাতে গিয়ে।"
এটি দেশটির সামরিক জান্তার নেতা জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের জন্য আরও একটি অপমানজনক পরাজয়। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের ২৭০ কিলোমিটার এলাকা পুরোপুরি আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।
বর্তমানে, শুধু রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্তে সামরিক শাসনের দখলে রয়েছে। তবে সেটি দেশটির বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন। এই পরিস্থিতিতে আরাকান আর্মি প্রথম বিদ্রোহী গোষ্ঠী হিসেবে একটি পুরো রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পথে রয়েছে।
এ বছরের শুরু থেকে আরাকান আর্মির কাছে পরাজিত হয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী একের পর এক শহর থেকে পিছু হটছে।
সর্বশেষ সেপ্টেম্বর মাসে সেনাবাহিনী মংডু সীমানার কাছে অবস্থিত বিজিপি৫ ঘাঁটিতে জড়ো হয়। ২০ হেক্টর এলাকা জুড়ে থাকা এই ঘাঁটি আরাকান আর্মির অবরোধের মুখে পড়ে।
বিজিপি৫ ঘাঁটি তৈরি হয় মিয়ানমারের মিও থু গি নামক একটি মুসলিম রোহিঙ্গা গ্রামে। ২০১৭ সালে সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের নির্মমভাবে বিতাড়িত করার সময় এই গ্রামটি পুড়িয়ে দেয়।
আরাকান আর্মি তাদের হতাহতের সংখ্যা প্রকাশ করে না। তবে জুন মাসে মংডুতে শুরু হওয়া তীব্র সংঘর্ষ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, তাদের শত শত যোদ্ধা প্রাণ হারিয়েছে।
অবরোধ চলাকালীন মিয়ানমারের বিমান বাহিনী মংডু শহরে নিয়মিত বোমা বর্ষণ করে। এতে সাধারণ মানুষ শহর ছেড়ে চলে যায়।
বিমানগুলো রাতে অবরুদ্ধ সেনাদের জন্য সরঞ্জাম ফেলে দিত। তবে তা কখনোই যথেষ্ট ছিল না। স্থানীয় সূত্র জানায়, বাঙ্কারগুলোতে প্রচুর চাল মজুত ছিল। কিন্তু আহতদের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ফলে সৈন্যদের মনোবল ভেঙে যায়।
গত সপ্তাহে তারা আত্মসমর্পণ শুরু করেন।
আরাকান আর্মির ভিডিওতে দেখা যায়, আহত সৈন্যরা সাদা কাপড় উড়িয়ে বের হয়ে আসছে্ন। কেউ কেউ নিজস্ব কাঠের ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটছেন, কেউ লাফিয়ে চলছেন আর কারও আহত পা কাপড়ে মোড়ানো। তাদের বেশিরভাগের পায়ে জুতো ছিল না।
ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনগুলোর ভেতরে বিদ্রোহীরা লাশের স্তূপের ভিডিও ধারণ করেন।
আরাকান আর্মি জানায়, অবরোধে ৪৫০ জনেরও বেশি সৈন্য নিহত হয়েছে। তারা ধরা পড়া কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থুরেইন তুন এবং তার কর্মকর্তাদের ছবি প্রকাশ করেছে। ছবিতে দেখা যায়, তারা পতাকা দণ্ডের নিচে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন। সেখানে এখন বিদ্রোহীদের পতাকা উড়ছে।
মিয়ানমারে সামরিক সমর্থকরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। একজন লিখেছেন, "মিন অং হ্লাইং, আপনি কি আপনার সন্তানদের সামরিক বাহিনীতে পাঠিয়েছেন? রাখাইনে এত মৃত্যু দেখে আপনি কি খুশি?"
আরেকজন মন্তব্য করেন, "এই গতিতে তাতমাদাউ [সামরিক বাহিনী] থেকে শুধু মিন অং হ্লাইং আর একটি পতাকা দণ্ডই বাকি থাকবে।"
বিজিপি৫ ঘাঁটির পতন আরাকান আর্মিকে মিয়ানমারের অন্যতম কার্যকর সামরিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আরাকান আর্মি তুলনামূলক নতুন। এটি প্রথমে চীনের সীমান্তে কর্মসংস্থানের সন্ধানে যাওয়া রাখাইন যুবকদের নিয়ে গঠিত হয়। পরে এটি "থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স"-এর অংশ হয়। এই জোট জান্তাকে বড় পরাজয়ে বাধ্য করেছে।
যদিও অন্য দুই সদস্য শান রাজ্যে সীমান্তে অবস্থান করছে, আরাকান আর্মি আট বছর আগে রাখাইনে ফিরে আসে। তারা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে আত্ম-শাসনের জন্য লড়াই করছে।
আরাকান আর্মির নেতৃত্বে আছে বুদ্ধিমান ও অনুপ্রেরণাদায়ী নেতা। তারা ইতোমধ্যে রাখাইনের বড় অংশ স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের মতো পরিচালনা করছে।
তাদের শক্তিশালী অস্ত্র রয়েছে। চীনা সীমান্তের পুরোনো বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সংযোগের মাধ্যমে এসব অস্ত্র এসেছে। তারা আর্থিকভাবেও সচ্ছল।
তবে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, বিভিন্ন জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী সামরিক জান্তার উৎখাতকে কতটা অগ্রাধিকার দেবে?
সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত ছায়া সরকার বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিরক্ষা বাহিনীর সমর্থন পেতে একটি ফেডারেল রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। এতে অঞ্চলগুলো স্ব-শাসনের অধিকার পাবে।
তবে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের অন্য দুই সদস্য চীনের আহ্বানে অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হয়েছে। চীন গৃহযুদ্ধের একটি সমঝোতামূলক সমাপ্তি চায়, যা সম্ভবত সামরিক জান্তার কিছু ক্ষমতা অক্ষত রাখবে।
বিরোধীরা সেনাবাহিনীর সংস্কার ও রাজনীতি থেকে অপসারণের দাবি জানাচ্ছে। তবে জান্তার বিরুদ্ধে বড় এলাকা দখল করার পর, জাতিগত বিদ্রোহীরা চীনের সমর্থনে জান্তার সঙ্গে সমঝোতা করার প্রলোভনে পড়তে পারে।
আরাকান আর্মির (এএ) বিজয় আরও উদ্বেগজনক প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। এর নেতৃত্ব তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে নীরব। রাখাইন একটি দরিদ্র এলাকা, যেখানে গত এক বছরের তীব্র লড়াইয়ে বিশাল ক্ষতি হয়েছে।
মংডু ছেড়ে বাংলাদেশে চলে আসা একজন রোহিঙ্গা বিবিসিকে বলেন, "মংডু ও আশপাশের ৮০ শতাংশ ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। শহর জনশূন্য। প্রায় সব দোকান ও ঘর লুট হয়েছে।"
গত মাসে জাতিসংঘ রাখাইনে দুর্ভিক্ষের সতর্কতা দিয়েছে। সেনাবাহিনীর অবরোধের কারণে বহু লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং ত্রাণ সরবরাহে বাধা সৃষ্টি হয়েছে।
আরাকান আর্মি নিজস্ব প্রশাসন গড়ার চেষ্টা করছে। তবে বাস্তুচ্যুতদের সহায়তা করার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে।
এএ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি কী মনোভাব দেখাবে, তা এখনও পরিষ্কার নয়। রাখাইনে এখনও প্রায় ৬ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে, যদিও ২০১৭ সালে ৭ লাখ রোহিঙ্গা বিতাড়িত হয়েছিল।
মংডু দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত এলাকা। কিন্তু এএ-র সমর্থিত রাখাইন জনগোষ্ঠীর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সম্পর্ক সবসময় উত্তেজনাপূর্ণ ছিল।
রোহিঙ্গা প্রভাবশালী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে সেনাবাহিনীর পক্ষ নিয়েছিল, যা এএ-এর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আরও খারাপ করেছে।
তবে অনেক রোহিঙ্গা মনে করেন, তারা এএ-র শাসনে নিরাপদ থাকবেন। যদিও এএ ইতোমধ্যে দখল করা শহরগুলো থেকে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে বিতাড়িত করেছে এবং তাদের ফিরে আসতে দেয়নি।
এএ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তারা ভবিষ্যৎ স্বাধীন রাখাইন রাজ্যে সব সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করবে। তবে তারা সে-সব রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, যারা সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করেছে।
বাংলাদেশে থাকা একজন রোহিঙ্গা বলেন, "রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমার সরকারের কাছে নিপীড়িত হয়েছে এবং রাখাইন জনগণ তা সমর্থন করেছে। সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করতে চায়, কিন্তু রাখাইনরা মনে করে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের একেবারেই থাকা উচিত নয়। আমাদের বর্তমান অবস্থা সামরিক জান্তার শাসনের চেয়েও কঠিন।"