বেনজীর অ্যান্ড কোং আনলিমিটেড: নতুন যেসব সম্পদের খোঁজ মিলল
রাজধানীর অদূরে পূর্বাচলসংলগ্ন রূপগঞ্জের আনন্দ হাউজিং সোসাইটির একমাত্র বাংলোবাড়িটির সামনে দাঁড়ালে যে-কেউ সহজেই বুঝে নেবে, এটি কোনো অভিজাত ব্যক্তি বা পরিবারের একটি প্রমোদস্থল। বাড়িটি নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে বিদেশ থেকে আমদানি করা মূল্যবান মার্বেলপাথর, টাইলস ও গ্লাস। বৃষ্টিবিলাসের জন্য বাড়িটিতে দেওয়া হয়েছে বিদেশি ঢেউটিনের চালা।
আকর্ষণীয় বাড়িটি একেবারেই নজরকাড়া। এটি পুলিশেরে সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের একটি বিশেষ বাংলোবাড়ি।
বুধবার (১২ জুন) আরও ১০০ বিঘা জমি, ৮টি ফ্ল্যাটসহ সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের আরও বিপুল পরিমাণ সম্পদ জব্দ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। সে তালিকায় রয়েছে এ বাংলোটিও। বলা হচ্ছে, বাড়িটির মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। এছাড়া জব্দ করা হয়েছে বেনজীর ও তার পরিবারের মালিকানাধীন দুটি কোম্পানিও জব্দ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে।
বেনজীর এবং তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে একের পর এক বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে। বেনজীর ও তার পরিবার কী পরিমাণ সম্পদের মালিক, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।
বেনজীরের বিপুল সম্পদের খবরে বিস্মিত হয়েছেন হাইকোর্টও। বুধবার পৃথক একটি মামলার শুনানিকালে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াত লিজুর হাইকোর্ট বেঞ্চ বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, 'একজন পুলিশ মহাপরিদর্শক কীভাবে এত সম্পদের মালিক হলেন? এটি আমাদের বিস্মিত করেছে।'
এছাড়া বেনজীরের সম্পদ নিয়ে তৃতীয় দফার অনুসন্ধান শেষে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, 'অনুসন্ধান সম্পন্ন করে যে পরিমাণ সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে, একজন মানুষ বা কোনো পরিাবেরর পক্ষে এই অল্প সময়ে এত পরিমাণ সম্পদ অর্জন স্বাভাবিক বিষয নয়।'
তিনি বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, দুদক বেনজীর ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে সরাসরি দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে; তাই বেনজীর ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে শিগগিরই মামলা করা হবে।
বেনজীরের বাংলো পরিদর্শন
বৃহস্পতিবার ২৪ কাঠা জমির ওপর অবস্থিত বেনজীরের বাংলোটি সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে স্থানীয়রা টিবিএসকে জানান, মাস দুয়েক আগেও এই বাড়িতে সপ্তাহের দুই-তিন দিন রাতভর চলত নানা ধনের ফুর্তির আসর।
স্থানীয়রা দাবি করেন, ওই সব আসরে যোগ দিতেন স্বনামধন্য অনেক ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা ও বিদেশি অতিথি। তাদের জন্য নানা ধরনের অভিজাত খাবার মেন্যুর সঙ্গে প্রায়ই যোগ হতো হরিণের মাংস।
স্থানীয়রা বলেন, এসব পার্টির দিন ওই বাংলোসংলগ্ন সড়কগুলোতে সাধারণ মানুষের চলাচল নিষেধ থাকত। পাহারায় থাকতেন সাদাপোশাকের পুলিশ আর নিজস্ব বাহিনীর লোকজন।
অনেক নারী মডেল ও অভিনেত্রীও নিয়মিত ওইসব পার্টিতে আসতেন বলে জানান স্থানীয়রা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই বাড়ির একজন সাবেক প্রহরী বলেন, বাড়িটির ভেতরে রয়েছে অভিজাত সুইমিং পুল, বিদেশি কুকুর, ম্যাকাও গোল্ড পাখিসহ নানা ধরনের বিদেশি পাখি এবং অনেকগুলো হরিণ নিয়ে একটি মিনি চিড়িয়াখানা।
দুদকে হিসাবে, জমিসহ ওই বাড়িটির প্রকৃত মূল্য ৪৫ কোটি টাকার বেশি। স্থানীয় লোকজনও জানান এই মূল্যের কথা। কিন্তু বেনজীর ওই ২৪ কাঠা জমির মূল্য দেখিয়েছেন মাত্র ২৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা।দুদক বলছে, বেনজীর এই চারটি প্লট কিনেছেন আইজিপি হিসেবে অবসরে যাওয়ার ঠিক একদিন আগে, ২০২২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর।
গত এপ্রিল মাসের শেষ নাগাদ দুদক বেনজীরের অবৈধ আয় নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করলে বাংলোবাড়িটিতে থাকা তিনটি বিলাসবহুল গাড়ি, বাড়ির ভেতরে থাকা দামি অসবাব ও মিনি চিড়িয়াখানা রাতের বেলায় গোপনে সরিয়ে ফেলা হয় বলে জানান স্থানীয় চা-দোকানি মিনহাজ উদ্দিন।
মনিরুল ইসলাম নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, এখন দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসছেন বাড়িটি দেখতে।
তিনি বলেন, 'তারা ছবি তুলতে, ভিডিও করতে আসছেন। এভাবে চলতে থাকলে শিগগিরই হয়তো দেখব টিকিট কেটে বাড়িটা দেখানো হচ্ছে। হকাররা হয়তো দোকান নিয়ে বসে যাবে এখানে। সবাই দেখতে আসবে আমাদের পুলিশ অফিসাররা কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত।'
বেনজীরের আরও সম্পদ
বেনজীরের রূপগঞ্জের বাংলোটি ছাড়াও উত্তরায় ৩ কাঠা জমি, বাড্ডায় ৩৯.৩০ কাঠা জমিতে দুটি ফ্ল্যাট, বান্দরবান জেলায় ২৫ একর জমি, আদাবর থানায় পিসি কালচার হাউজিংয়ে বেনজীরের স্ত্রী জিশানের নামে নিবন্ধিত ছয়টি ফ্ল্যাট, গুলশানে তার বাবার কাছ থেকে পাওয়ার অভ অ্যাটর্নির মাধ্যমে প্রাপ্ত একটি ৬ তলা ভবন এবং সিটিজেন টিভি ও টাইগার অ্যাপারেলসের শেয়ার জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত ।
এর আগে দু্ই দফায় গত ২৩ ও ২৬ মে আদালত বেনজীর পরিবারের ৬২১ বিঘা জমি জব্দ করার আদেশ দিয়েছেন। এছাড়া বেনজীর পরিবারের ৩৮টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ এবং পরিবারের মালিকানাধীন কোম্পানিও জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। দুই দিনে আদালত প্রায় ৩৩ কোটি টাকার সম্পত্তি জব্দের আদেশ দিয়েছেন।
এর আগে স্থানীয়দের বরাতে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা গিয়েছিল, বান্দরবানে বেনজীরের ১০০ একর জমি রয়েছে। এই সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে মাছ ও গবাদিপশুর খামার, একটি বাগান ও একটি বিলাসবহুল বাংলো।
অভিযোগ রয়েছে, পুলিশপ্রধানের দায়িত্ব পালনকালে তিনি প্রথমে ২৫ একর জমি লিজ নেন। এরপর তিনি আশপাশের এলাকা দখল করেন বলে অভিযোগ। এই জমিতে এখন মাছ ও গবাদিপশুর খামার, একটি বড় বাগান এবং একটি দোতলা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাংলো রয়েছে। প্রবেশের জন্য একটি ব্যক্তিগত রাস্তাও তৈরি করা হয়েছে।
অনুসন্ধান এখন আন্তর্জাতিক পরিসরে
তিন দফা অনুসন্ধান করার পর দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, দুবাই, কানাডা ও মালেশিয়ায়সহ বিভিন্ন দেশে বেনজীরের সম্পদ অনুসন্ধান চলছে।
যদি আরও সম্পদের সন্ধান পাওয়া যায়, তাহলে দুদক সেগুলো জব্দের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হবে বলে জানান তিনি। এই আইনজীবী বলেন, অনুসন্ধান কাজ শেষ করতে আরেকটু সময় প্রয়োজন, কারণ আরও বেশি পরিমাণ সম্পদের অনুসন্ধান পাওয়ার বিষয় সামনে এসছে।
বেনজীরের বিরুদ্ধে কবে নাগাদ মামলা হবে জানতে চাইলে খুরশীদ আলম বলেন, তৃতীয় দফা অনুসন্ধানে বেনজীরর আহমেদ এবং তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে দুদক নতুন করে যেসব জমি, ফ্ল্যাট ও কোম্পানির শেয়ারের সন্ধান পেয়েছে, সেগুলো তত্ত্বাবধানের জন্য রিসিভার নিয়োগের আবেদন করা হবে। এর আগে দুই দফায় পাওয়া ৬২১ বিঘা জমি, ৩৮টি ব্যাংক হিসাব ও ১৫ কোম্পানির শেয়ার তত্ত্বাবধানে রিসিভার নিয়োগ দিয়েছেন আদালত।
তিনি আরও বলেন, অনুসন্ধান কার্যক্রম শেষ হলে বেনজীর ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে শিগগিরই মামলা করবে দুদক। মামলার পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যদি মনে করেন বেনজীর ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তার করা প্রয়োজন, তাহলে তিনি আদালতে সেই আবেদন করবেন।