যেভাবে গড়ে উঠলো চট্টগ্রামের প্রথম দুম্বার খামার
যুক্তরাজ্য থেকে স্নাতক পাশ করে দেশে ফিরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার ফৌজদারহাট এলাকার যুবক আদনান চৌধুরী। করোনা মহামরির সময় সেই চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছিলেন তিনি।
বেকার সময়কে কাজে লাগাতে অনেকটা শখের বশেই নিজের জমানো টাকায় শুরু করেন বিদেশি জাতের ছাগল ও দুম্বা লালন-পালন। মাত্র তিন বছরে তা রূপ নেয় অনন্য এক উদ্যোগে। তার হাত ধরেই গড়ে ওঠে চট্টগ্রামের প্রথম দুম্বার খামার।
এর পাশাপাশি বিদেশি জাতের ভেড়া ও মুরগীর চাষও করছেন সফল এই খামারি। বর্তমানে তার তিনটি খামারে কর্মসংস্থান হয়েছে ১৬ জন কর্মচারী, দুইজন ম্যানেজার ও দুই জন সেলস এক্সিকিউটিভসহ মোট ২০ জন যুবকের।
ছোট্ট একটি ভুল থেকে শুরু যেভাবে
২০১৯ সালে কোরবানি দিতে স্থানীয় এক খামারীর কাছ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় এক জোড়া আফ্রিকান বোর প্রজাতীর ছাগল কিনেছিলেন আদনান চৌধুরী। তবে, ছাগল দুটি কেনার সময় ছোট্ট একটি ভুল করেছিলেন তিনি।
আকারে বড় ও ওজনে বেশি হওয়ায় ছাগল দুটির দাঁত গজিয়েছে কি-না তা না দেখেই কিনে ফেলেন। বাড়িতে আনার পর জানতে পারলেন দাঁত না গজানোয় কোরবানি দেওয়া যাবে না ছাগল দুটো।
অগত্যা ছাগল দুটো লালন-পালন করে পরের বছর কোরবানি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন আদনান। তবে কিছু দিন না যেতেই ওই জোড়ার মেয়ে ছাগলটি অসুস্থ হয়ে পড়লে চিন্তিত হয়ে পড়েন তিনি। স্থানীয় এক পশু চিকিৎসক পরীক্ষা করে জানালেন ছাগীটি গর্ভবতী। এই খবরে তিনি ছাগীটি প্রতি অতিরিক্ত যত্ন নিতে থাকেন।
মাস তিনেক পর ছাগীটি একটি বাচ্চার জন্ম দেয়। ছাগলের বাচ্চাকে পেয়ে তার দুই বছরের ছেলে জায়েরিশ আনন্দে আত্মহারা। ছাগল তিনটিকে নিয়েই দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে তার। তাই দেখে আদনান যে ব্যাপারীর কাছ থেকে ছাগল দুটি কিনেছিলেন, তার সাথে যোগাযোগ করে একই প্রজাতির আরও পাঁচটি ছাগল কিনে নিয়ে আসেন। ভাগ্যক্রমে তার মধ্যে তিনটিই ছিল গর্ভবতী।
মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই তার বাড়িতে ছাগলের সংখ্যা দাড়ায় ১১টিতে। তবে, তখন পর্যন্ত তার কাছে ছাগল পালন ছিল শুধুই শখের।
এরমধ্যে এসে পরে করোনা মহামারি। অনেকের মত আদনানও চাকরি হারিয়ে হয়ে যান বেকার। তখন তিনি ছাগলগুলো লালনপালন করেই দিন পার করছিলেন।
এ সময় বেশ কয়েকটি ছাগল একসাথে বাচ্চা দেওয়ায় তার বাড়ির পাশের ছোট ঘরটিতে জায়গা দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তখন তিনি বাণিজ্যিকভাবে ছাগল পালনের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের জমানো টাকায় গড়ে তুললেন আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত একটি খামার। নাম দেন ইউনিক গোট ফার্ম।
গুগল ইউটিউব ঘেটে জানতে শুরু করলেন বিভিন্ন বিদেশি জাতের ছাগল সম্পর্কে। দেশের বিভিন্ন সৌখিন খামারিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে থাকেন একের এক নতুন জাতের ছাগল। এভাবে ২০২১ সালের মধ্যে তার খামারে ছাগলে সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় শতাধিক। ছাগলের ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের পেজে আপলোড করা মাত্রই বিক্রি হতে থাকে তার ছাগলগুলো।
যেভাবে শুরু দুম্বা লালন-পালন
করোনা পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হয়ে আসার পর পরিবার নিয়ে গাজীপুরের একটি রিসোর্টে বেড়াতে গিয়ে আদনান দেখতে পান বিভিন্ন প্রজাতির দুম্বা ও ভেড়ার পালন হচ্ছে সেখানে। পরে সেখান থেকে তিনি পাঁচ প্রজাতির দুম্বা ও ভেড়া সংগ্রহ করে শুরু করেন লালনপালন। পুরোনো শেডের পাশাপাশি নির্মাণ করেন আরো একটি আধুনিক ও বড় শেড।
বিভিন্ন খামারির কাছ থেকে সংগ্রহ করা দুম্বাগুলো ও প্রজননের মাধ্যমে বাড়তে থাকে সংখ্যা। বর্তমানে তার খামারে তিন শতাধিক বোয়ের (আফ্রিকা), কালাহারি (আফ্রিকা), বারবারি (ভারত), কাশমের (কাশমির) ও ক্রস প্রজাতির ছাগল এবং ডোরপার (দক্ষিণ আফ্রিকা), স্থানীয় ভেড়া ও তুস্কের হারলি কুইন, পার্সিয়ান, আওয়াসি প্রজাতির দুম্বা রয়েছে— যার বাজারমূল্য দুই কেটি টাকার কাছাকাছি।
এরপর যোগ হয় বিদেশি প্রজাতির মুরগী
ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা পালনে সফলতায় অনুপ্রাণিত হয়ে গত বছর থেকে বিভিন্ন বিদেশি জাতের ফেন্সি চিকেন ও দেশীয় প্রজাতির ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগী লালন-পালনও শুরু করেছেন।
তার বাবা আজম চৌধুরীর বিনিয়োগে গড়ে তুলেছেন ১০ হাজার মুরগীর শেড।
বর্তমানে, তার ফেন্সি চিকেনের খামারে সেবেলপট, পেন্সিল স্যাটিন, ফ্রিজেল, কোকিন, কোকো, কোকিন সিল্কি, ব্রাহামা, সেরেমা, সেব্রাইট, সুলতান, ইয়োকোহামা ও পোলিশ ক্যাপের মতো বিদেশি প্রজাতির শতাধিক মুরগী রয়েছে। এই মুরগীগুলোর ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে ধীরে ধীরে বড় করে তুলছেন এই খামার।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
আদনান চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "দুম্বা মধ্যপ্রাচ্যের বা মরু অঞ্চলের প্রাণি হলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর কয়েকটি জনপ্রিয় প্রজাতি রয়েছে। বাংলাদেশের আবহাওয়াতে এরা দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে। দেশে কোরবানির প্রাণি হিসেবে দুম্বার চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকায় দামও পাওয়া যায় বেশ ভালো।"
তিনি বলেন, "আমার খামারে ৭৫ থেকে ১৫০ কেজি ওজনের এক একটি দুম্বা দেড় থেকে দুই লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি বছর শুধু দুম্বা বিক্রি করেই ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা আয় হয় আমার খামারে।"
তবে দুম্বা লালনপালনে বিশেষজ্ঞ পশু চিকিৎসকের পরামর্শে নিতে হয় অতিরিক্ত যত্ন। তাদের ভালো খাবারদাবার, অষুধপত্র এবং টিকাও দিতে হয় নিয়মিত।
আদনান বলেন, "যুক্তরাজ্য থেকে লেখাপড়া শেষ করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চাকরি করেছি দীর্ঘদিন। ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় চাকরি হারিয়ে বেকার হওয়ার পর ছাগলের খামার দেওয়ার পরিকল্পনা করি।"
তিনি বলেন, "দ্রুত সাফল্যের মুখ দেখায় ধীরে ধীরে বড় করতে থাকি খামার। ধাপে ধাপে মোট ২৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে গড়ে তুলেছি তিনটি খামার। আমার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আমার বাবাও বিনিয়োগ করে খামারে। বর্তমানে আমার এখানে দুটি ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার খামারের পাশাপাশি আছে ১০ হাজার ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগীর শেড।"
তিনি আরও বলেন, "আমার খামার দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে এলাকার অনেক যুবক ছাগল লালনপালনে এগিয়ে আসছে।"
দেশের যুবকদের চাকরির পেছনে না ছুটে কৃষি ও লাইভস্টক উদ্যোক্তা হয়ে উঠে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার আহবান জানান আদনান চৌধুরী।
চট্টগ্রাম জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম জানান, "চট্টগ্রামে দুম্বা চাহিদা কম থাকায় তেমন কোনো বাণিজ্যিক খামার গড়ে ওঠেনি। আমার জানা মতে, ইউনিক গোট ফার্মই সম্ভবত চট্টগ্রামের প্রথম দুম্বার খামার।"
আদনান চৌধুরীর সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে চট্টগ্রামের খামারীরা দুম্বা লালনপালনে এগিয়ে আসবেন বলে আশা প্রকাশ করেন এই প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা।