সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি, পানিবন্দি ৭ লাখ মানুষ
সিলেটে গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি কিছুটা কমেছে। তবে অব্যাহত রয়েছে পাহাড়ি ঢল। এতে বন্যা পরিস্থিতিতির আরও অবনতি হয়েছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। বুধবার (১৯ জুন) সকাল পর্যন্ত পানিবন্দি আছে প্রায় সাত লাখ মানুষ।
সিলেট জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত নগরের ২১টি ওয়ার্ড ও জেলার ১ হাজার ৩২৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ৬ লাখ ৭৫ হাজার মানুষ বন্যা আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে নগরের অর্ধলক্ষ লোক পানিবন্দী।
জেলা ও নগর মিলিয়ে ৬২৭টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে নগরে ৮০টি। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ১৭ হাজার ২৮৫ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। তবে বেশিরভাগ মানুষ নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে ইচ্ছুক নন। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন পাড়া-প্রতিবেশীদের উঁচু বাসা-বাড়ি বা আত্মীয়-স্বজনের ঘরে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট কার্যালয় সূত্র বুধবার সকাল ৯টায় জানিয়েছে, এ সময় সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৯১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। একই নদীর সিলেট পয়েন্টে পানি বইছে বিপৎসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে। কুশিয়ারা নদীর আমলশীদ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। একই নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ৯২ ও শেরপুর পয়েন্টে বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি বইছে।
এছাড়া সারি-গোয়াইন নদীর সারিঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ০.৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
সিলেটের সীমান্তবর্তী পাঁচ উপজেলা গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ ও জকিগঞ্জের পাশাপাশি বন্যা ছড়িয়ে পড়েছে সদর, দক্ষিণ সুরমা, বিশ্বনাথ, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও বালাগঞ্জ উপজেলায়। এসব উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
২০ দিনের ব্যবধানে সিলেটে এ নিয়ে দ্বিতীয় দফা বন্যা দেখা দিয়েছে। এর আগে গত ২৭ মে সিলেট বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এতে জেলার সব উপজেলার সাড়ে ৭ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়। সেই বন্যার পানি পুরোপুরি নামার আগেই ১৫ জুন থেকে ফের বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে সিলেট।
এর মধ্যে ঈদের দিন (১৭ জুন) ভোররাত থেকে সিলেটে শুরু হয় ভারী বর্ষণ। সঙ্গে নামে পাহাড়ি ঢল। সকাল হতে না হতেই তলিয়ে যায় নগরের অনেক এলাকা। জেলার বিভিন্ন স্থানেও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। মাটি হয়ে যায় সিলেটের ঈদ আনন্দ।
২০২২ সালে সিলেটে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা হয়। এবারের বন্যা দুই বছর আগের সেই স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে সিলেটবাসীকে।
নগরের তালতলা এলাকার বাসিন্দা নিলয় দাশ বলেন, 'যেভাবে পানি বাড়ছে, তাতে এবার মনে হয় ২০২২ সালের বন্যাকেও ছাপিয়ে যাবে।'
তিনি বলেন, 'গতকালকেই আমার বাসায় পানি ঢুকে গেছে। পরিবারের লোকেদের আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে আমি একটি হোটেলে আশ্রয় নিয়েছি।'
ইতিমধ্যে নগরের শাহজালাল উপশহর, যতরপুর, মেন্দিবাগ, শিবগঞ্জ, রায়নগর, সোবহানীঘাট, কালিঘাট, কামালগড়, মাছিমপুর, তালতলা, জামতলা, কাজিরবাজার, মাদিনা মার্কেট, আখালিয়া, মেজরটিলা ও দক্ষিণ সুরমার লাউয়াই, বরইকান্দি, আলমপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় অনেকের বাসাবাড়িতে গলা পর্যন্ত পানি উঠেছে। নিচু এলাকাগুলোর কলোনি বা বাসা-বাড়ি প্রায় পুরোটাই তলিয়ে গেছে বন্যার পানিতে। এতে চরম বিপাকে এসব এলাকার মানুষ। অনেকে গেছেন আশ্রয়কেন্দ্রে, আবার অনেকে নিজের বাসা-বাড়ি ছেড়ে যেতে চাচ্ছেন না।
অপরদিকে সিলেট সদর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জৈন্তাপুরসহ কয়েকটি উপজেলার গ্রামীণ অনেক রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অনেক কৃষিজমির ফসল তলিয়ে গেছে, ভেসে গেছে পুকুরের মাছ।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজিব জানান, সিলেটে মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে বুধবার ৬টা পর্যন্ত ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে এবং বুধবার সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আগামী কয়েকদিন সিলেটে টানা বৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি।
সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান টিবিএসকে বলেন, সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধারের লক্ষ্যে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় তৎপরতা চালানো হচ্ছে। বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়গুলোতে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় ডেডিকেটেড অফিসার নিয়োগের পাশাপাশি প্রতিটি ইউনিয়নে ট্যাগ অফিসার নিয়োগ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, 'বন্যার্তদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য ইউনিয়নভিত্তিক মেডিকেল টিম গঠন করে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। আগামী ৩ দিন সিলেট অঞ্চলে ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস রয়েছে। এ অবস্থা চলমান থাকলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে।'