ট্র্যাজেডি থেকে জয়: সারওয়ার আলমগীরের হালদা গ্রুপ প্রতিষ্ঠার গল্প
ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি ও শোককে শক্তিতে পরিণত করে এক সমৃদ্ধশালী ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যে গড়ে তুলেছেন হালদা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সারওয়ার আলমগীর।
১৯৯৩ সালে এক সহিংস ঘটনায় ছোট ভাই মোক্তার হোসেন মানিককে হারানোর শোক থেকে শুরু হয় আলমগীরের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার যাত্রা।
প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে সারওয়ার আলমগীরকে খুঁজতে বাড়িতে হামলা করেন বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরা। তাকে না পেয়ে মারধর করা হয় ছোট ভাই মোক্তার হোসেন মানিককে। যিনি পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালের ২৫ মে তারিখে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতে ঢাকায় রাজনৈতিক বড় ভাইদের সঙ্গে দেখা ও পরামর্শ করতে যান তখনকার ফটিকছড়ির তরুণ সারওয়ার আলমগীর।
রাজনৈতিক বড় ভাইয়েরা সারওয়ার আলমগীরকে পরামর্শ দেন এই মুহূর্তে এলাকায় ফিরলে তাকেও মেরে ফেলতে পারেন বিরোধীরা। তাই আপাতত ঢাকায় অবস্থান করার নির্দেশনা দেন তারা। কিছুদিন ঢাকায় অবস্থান করার পর সেই বড় ভাইয়েরাই সুযোগ করে দেন ব্যবসার।
পরেরটা শোনা যাক সারওয়ার আলমগীরের মুখ থেকেই।
"ওই সময় টেলিফোন কোম্পানি আল কাতার খুঁটি স্থাপনের কাজ শুরু করি। প্রতি এক লাখ টাকার কাজ শেষে বিল পেয়ে যেতাম। প্রথমে ঢাকায় পরে চট্টগ্রামেও আমরা কাজ করি। এতে আমাদের ভালো আয় হয়। ওই টাকা দিয়ে ১৯৯৬ সালের দিকে আমরা মিরপুরে একটি গার্মেন্টস ভাড়া করি। কিন্তু ওই বছর অসহযোগ আন্দোলনে দীর্ঘদিন কারখানা বন্ধ থাকায় আমাদের লোকসানে পড়তে হয়," শুরুর গল্পটা এভাবেই খুলে বলেন সারওয়ার আলমগীর।
মিরপুরে 'ধাক্কা' খেয়ে সারওয়ার আলমগীর উঠে দাঁড়াতে বেছে নেন নিজের শহর চট্টগ্রামকেই। বললেন, "তখন ঢাকার শাহজানপুরে একটি বাসায় ভাড়া থাকতাম। সেখানে একজন গার্মেন্টসে কোটার ব্যবসা করতেন। উনার পরামর্শে চট্টগ্রামে বিভিন্ন গার্মেন্টেসের সাথে কোটার ব্যবসা শুরু করি। কোটার কমিশন থেকে ভালো আয় হয়, যা দিয়ে পরে ২০০১ সালে চার বন্ধুকে নিয়ে চট্টগ্রামে পোশাক কারখানা গড়ে তুলি। তবে অল্প সময়ের মধ্যে পার্টনারদের সঙ্গে ব্যবসা ভাগ হয়ে যায়।"
এরপর সারওয়ার নিজেই নিজের ব্যবসা গোছাতে শুরু করেন। জানিয়েছেন সেই সময়ের গল্পটাও।
"এক্সেসরিজ, ডাইয়িং, নিটিংসহ ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজসহ তৈরি পোশাক কারখানা গড়ে তুলি— যেখানে আমার জমানো টাকা এবং ব্যাংকের অর্থায়নে পোশাক কারখানা গড়ি। এরপর রপ্তানি পোশাক খাতে এক যুগের বেশি সময় ভালো ব্যবসা করি," বললেন আলমগীর।
অবশ্য এখানেও বাধার মুখে পড়তে হয় সারওয়ার আলমগীরকে। এবারের বাধাটা ভিন্ন, রাজনৈতিক। সারওয়ার আলমগীর সেই সমস্যাটি তুলে ধরে বলেন, "বিপত্তি ঘটে ২০১৪ সালে এসে। যখনই আমি উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচন করি। বিরোধী দলের হয়ে নির্বাচন করার পর থেকে রাজনৈতিক চাপ বাড়তে থাকে। কমতে থাকে ব্যাংকিং বিনিয়োগসহ ব্যবসায়িক অন্যান্য সুবিধা।"
তিনি বলেন, "এরপর বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণমান খারাপ হয়ে যায়। ক্রমাগত ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের অভাবে ব্যবসার ভলিউম কমে গেছে। ব্যাংকিং সাপোর্ট না পাওয়ায় প্রতিষ্ঠান চালাতে কষ্ট হচ্ছে। এরপরও জায়গা-সম্পত্তি বিক্রি করে হলেও এখনো কারখানা চালিয়ে যাচ্ছি। এই পর্যন্ত কারখানার কোনো কর্মী বিদায় করিনি।"
এত বাধা-বিপত্তির পরেও সারওয়ার আলমগীরের ব্যবসার পরিধি ছোট হয়নি, বরং বেড়েছেই। ১২০ জন কর্মী দিয়ে ছোট করে ব্যবসা শুরু করা হালদা গ্রুপে এখন কর্মীর সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। ৩০টি মেশিনারিজ থেকে এখন মেশিনের সংখ্যা ৮০০।
২০০১ সালে একটি প্রতিষ্ঠান দিয়ে শুরু করা হালদা গ্রুপের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এখন ৫টি। এরমধ্যে এন এফ জেড টেরি টেক্সটাইল এবং আল্ট্রা ডিজাইন অ্যান্ড ফ্যাশনে টি-শার্ট, পোলো শার্ট, বক্সার, বক্সার শর্ট, কেমিজ, কেমিসোল, এ-শার্ট, ট্যাঙ্ক টপসহ প্রায় সব ধরনের পোশাক তৈরি হয়— যার শতভাগ রপ্তানি হয় আমেরিকাতে।
বাকি দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হালদা অ্যাক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজে তৈরি পোশাকের যাবতীয় ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ অ্যাক্সেসরিজ ও আরেকটি আবাসন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান।
হালদা গ্রুপের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে সারওয়ার আলমগীর অন্যতম কারণ মনে করেন-গুণমান ধরে রাখাটা। বলেন, "আমরা শুরু থেকে পণ্যের সর্বোচ্চ মান অর্জন এবং তা বজায় রাখার চেষ্টা করছি। যে কারণে দুই যুগ ধরে গোল্ডেন টাচ-ইউএসএ, গ্ল্যাসি-ইউএসএ, টিজে ম্যাক্স ইউএসএ, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, এআই ট্রেডিং- ইউএসএ, এনামোর- ইন্ডিয়ার মতো বিশ্বের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে পণ্য রপ্তানি করে চলছি।"