চীনে প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ সফরে প্রাধান্য পাবে জাহাজ ক্রয়, বাণিজ্য সহায়তা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন বেইজিং সফরে চীনের ঋণে দুটি ক্রুড অয়েল মাদার ট্যাংকারসহ মোট চারটি বড় জাহাজ ক্রয়ের জন্য বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা দেশের আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির জন্য এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে উন্নয়নের গতি বজায় রাখার জন্য এ সফরকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বর্ণনা করেছেন।
কর্মকর্তারা বলছেন, কয়লা, খাদ্যশস্য, সিমেন্ট ক্লিঙ্কার এবং অন্যান্য পণ্য পরিবহনের জন্য দুটি মাদার বাল্ক ক্যারিয়ারসহ মোট ৪টি জাহাজকে দেশের বিদ্যমান বহরে অন্তর্ভুক্ত করার ফলে জ্বালানি তেলের মতো অতি-সংবেদনশীল পণ্য পরিবহনের জন্য বিদেশি জাহাজের ওপর দেশের নির্ভরতা কমবে।
৮–১১ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় বেইজিং থেকে চীনা মুদ্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলারের সমতুল্য একটি বাণিজ্য সহায়তা প্যাকেজ সম্পর্কে ঘোষণা আসার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এ ঋণের সুদের হার ১ শতাংশ এবং গ্রেস পিরিয়ড হবে পাঁচ বছর।
বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি) এ বাণিজ্য সহায়তার অর্থায়ন থেকেই এক হাজার ৬৭৬.৫৪ মিলিয়ন ইউয়ান বা প্রায় দুই হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে জাহাজগুলো কিনবে।
সরকার এ সফরে চীনের কাছ থেকে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল পাওয়ার আশা করছে, যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ করা হয়েছে।
২ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা, সেপা'র সূচনা ও আরও
প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে চীন বাংলাদেশকে রিজার্ভ সহায়তা বা বাজেট সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে একটি ঘোষণা আসতে পারে বলে জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ চীনের কাছে দুই বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা চেয়েছে।
এছাড়া, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত উদ্যোগ, একটি মেট্রোরেল নির্মাণ, পায়রা বন্দরসহ দক্ষিণাঞ্চলে উন্নয়ন প্রকল্প ও বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য চীনা ঋণপ্রাপ্তিসহ পাশাপাশি কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (সেপা)-এর আনুষ্ঠানিক সূচনা সম্পর্কে ঘোষণা আসতে পারে।
সূত্রমতে, সফরের সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রায় ১৭টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ), চুক্তি বা লেটার অব ইনটেন্ট বিনিময় হতে পারে।
এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং চীনের অর্থায়নে বাংলাদেশে সম্পন্ন বেশ কয়েকটি প্রকল্প আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন। এর মধ্যে রয়েছে এস আলম গ্রুপের এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইদ ডাবল পাইপলাইন প্রকল্প।
বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা-ইউয়ানে বাণিজ্য শুরু করতে চীনের ন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল রেগুলেটরি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এর সঙ্গে একটি এমওইউ স্বাক্ষর করতে পারে।
সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিংয়ে জ্বালানি পরিবহনের জন্য মাদার ট্যাংকার
বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চীনা এক্সিম ব্যাংক থেকে ২০ বছর মেয়াদি ও পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডের ঋণ নিয়ে জাহাজগুলো কেনা হবে। এগুলো সরবরাহ করবে চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশন।
প্রতিটি ক্রুড অয়েল মাদার ট্যাংকারের ধারণক্ষমতা এক লাখ ১৪ হাজার ডিডব্লিউট (ডেডওয়েট টনেজ)। আর মাদার বাল্ক ক্যারিয়ারগুলোর ধারণক্ষমতা ৮১ হাজার ৫০০ ডিডব্লিউট। জাহাজগুলোর নির্মাণকাল ধরা হয়েছে ৩২–৩৪ মাস।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিএসসি কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, চীনা অর্থায়নে এ চারটি জাহাজ কেনার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষর বা ঘোষণা আসতে পারে।
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর মাহমুদুল মালেক বলেন, বাংলাদেশের পক্ষে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে। চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই জাহাজগুলোর নির্মাণ কাজ শুরু হবে এবং দুই বছরের মধ্যে সেগুলো সরবরাহ করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ক্রুড অয়েল মাদার ট্যাংকার সম্পর্কে তিনি বলেন, মাদার ট্যাংকারগুলো সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইদ ডাবল পাইপলাইন প্রকল্পের কাছে তেল পরিবহন করবে।
প্রতিটি ক্রুড অয়েল মাদার ট্যাংকারের দাম পড়বে ৭৮০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। আর প্রতিটি মাদার বাল্ক ক্যারিয়ারের আমদানি ব্যয় হবে ৪৬২ কোটি ৩১ লাখ টাকা।
বিএসসি কর্মকর্তাদের মতে, জাহাজগুলো বছরে প্রায় ২০ লাখ টন অপরিশোধিত তেল এবং ১৫.২ লাখ টন কার্গো পরিবহন করবে।
বিএসসি'র কাছে বর্তমানে এত বড় মাদার ট্যাংকার নেই। কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের লক্ষ্য এ নতুন জাহাজগুলো ব্যবহার করে অপরিশোধিত তেল পরিবহনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা।
এর আগে, বিএসসি চীন থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তিনটি প্রোডাক্ট অয়েল ট্যাংকার এবং তিনটি বাল্ক ক্যারিয়ার কিনেছিল, যেগুলো ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে বিএসসির বহরে যুক্ত হয়।
অবকাঠামো ও নির্মাণ বিষয়ে সমঝোতা স্মারক
প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে ইআরডি এবং চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে অবকাঠামো ও প্রকৌশল নির্মাণে সহযোগিতা গভীর করার (ডিপেনিং কো-অপারেশন ইন ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন) বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা রয়েছে।
পাশাপাশি, ইআরডি চীনের নেতৃত্বাধীন গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ-এ যোগ দিতে চায়না ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির সঙ্গে একটি পৃথক এমওইউ স্বাক্ষর করতে পারে। ইআরডি চীনের অর্থায়নে দেশে ৯ম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে চীনা এ সংস্থার সঙ্গে আরেকটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করবে।
দুই শীর্ষ নেতার যৌথ বিবৃতিতে সেপা'র যৌথ সম্ভাব্যতা সমীক্ষার সমাপ্তি ঘোষণা করে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা এবং চীন-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তির জন্য আলোচনা শুরুর ঘোষণা আসতে পারে।
চীনের অর্থায়নে দেশের পৌরসভায় পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন, নিষ্কাশন, কঠিন বর্জ্য এবং পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রকল্পের পাশাপাশি ঢাকা শহরের জন্য দাশেরকান্দি এসটিপি ক্যাচমেন্ট প্রকল্পের অধীনে পয়োবর্জ্য সংগ্রহ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের বিষয়ে ঘোষণা দেওয়া হতে পারে।
এছাড়া, দুই নেতা যৌথভাবে মডার্নাইজেশন অব টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক ফর ডিজিটাল কানেক্টিভিটি প্রকল্প উদ্বোধন করতে পারেন বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
'মূলত জাতীয় স্বার্থ'
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের মূল কারণ জাতীয় স্বার্থ।
'মূলত এ সফরে ভূ-রাজনৈতিক বিষয়গুলোর চেয়ে অর্থনৈতিক বিবেচনা গুরুত্বপূর্ণ,' তিনি টিবিএসকে বলেন।
তবে তিনি আরও বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখাও এ সফরের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। রোহিঙ্গা সংকট এ অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এ সমস্যা সমাধানে চীনের সহায়তা চাইবে বাংলাদেশ।'
শাবাব খান আরও বলেন, এ সফরে বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিশীলতা, ডেফারেল পেমেন্ট ব্যবস্থা ও বাজেট সহায়তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনাও সফরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
'সরকার বিশেষ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় চীনের সহায়তা চাইছে। এর মধ্যে শুধু তিস্তা নদীই নয়, সামগ্রিকভাবে অভ্যন্তরীণ পানি ব্যবস্থাপনাও অন্তর্ভুক্ত,' তিনি বলেন।
অধ্যাপক শাহাব এনাম খান বলেন, 'দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে চীনের অর্থায়নের লক্ষ্য সরকারের। এ উন্নয়ন শুধু বাংলাদেশের জন্যই উপকারী নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ উন্নত করতে চীনের অর্থায়নে পরিচালিত অবকাঠামো প্রকল্পগুলোকে ত্বরান্বিত করাও এর লক্ষ্য।'
তিনি আরও বলেন, 'বাংলাদেশ ডিজিটাল সংযোগ বাড়াতে চীনের সহযোগিতা প্রত্যাশা করছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরে চীন থেকে প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং এ খাতে চীনা বিনিয়োগ গুরুত্ব পাবে। চীন বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন প্রচেষ্টার সমন্বয়ে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।'