চিকিৎসার জন্য পকেট থেকে খরচ করে ২০২২ সালে গরিব হয়েছেন ৬১ লাখ জন: বিআইডিএস
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)-এর সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুসারে, ২০২২ সালে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে ৬১ লাখ বাংলাদেশি তথা মোট জনসংখ্যার ৩ দশমিক ৭ শতাংশ দারিদ্র্যসীমায় প্রবেশ করেছেন।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, চিকিৎসার ক্ষেত্রে ক্যান্সার রোগীদেরকে নিজেদের পকেট থেকে (আউট-অব-পকেট খরচ) সবচেয়ে বেশি খরচ করতে হয়েছে। এ ধরনের ব্যয়ে তারপরে রয়েছে কোভিড-১৯ সংক্রমণের শিকার রোগীরা। হার্ট, কিডনি, লিভার ও মানসিক স্বাস্থ্যজনিত অসুবিধা রয়েছে — এমন রোগীদেরও খরচের পরিমাণ অনেক বেশি।
বিআইডিএস-এর রিসার্চ ফেলো আব্দুর রাজ্জাক সরকার সোমবার (১৫ জুলাই) বিআইডিএস সম্মেলন কক্ষে এক সেমিনারে 'ক্যাটাস্ট্রফিক হেলথ শক অ্যান্ড ইমপোভারিশমেন্ট ইন বাংলাদেশ: ইনসাইট ফ্রম এইচআইইএস ২০২২' শীর্ষক গবেষণাটির ফলাফল উপস্থাপন করেন। বিআইডিএস খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২ থেকে তথ্য বিশ্লেষণ করে এ গবেষণাটি পরিচালনা করেছে।
অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেনসহ বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদেরা উপস্থিত ছিলেন।
গবেষণা অনুযায়ী, সব ধরনের রোগীর পকেট থেকে খরচের একটি বড় অংশ চলে যায় ঔষধ কিনতে। হাসপাতালের বাইরে চিকিৎসা নেওয়া রোগীরা তাদের মোট ব্যয়ের ৫৪ শতাংশ এবং হাসপাতালে ভর্তি রোগীরা ২৪ শতাংশ ঔষধ বাবদ খরচ করেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল হেলথ এক্সপেন্ডিচার ডেটাবেজের উদ্ধৃতি দিয়ে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশিদের পকেট থেকে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় ৫৬ শতাংশের নিচে ছিল। তবে ২০২১ সাল নাগাদ এটি বেড়ে ৭৩ শতাংশে উন্নীত হয়, যা আফগানিস্তানের পরে দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
তবে সামগ্রিক স্বাস্থ্যব্যয়ের ক্ষেত্রে ২০২১ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু ব্যয় ছিল মাত্র ৫৮ ডলার, যা পাকিস্তানের ৪৩ ডলারের পরে এ অঞ্চলে সর্বনিম্ন।
সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলেন, চিকিৎসাব্যয়ের ক্রমবর্ধমান এ আর্থিক বোঝা সামাজিক বৈষম্যকে আরও খারাপ করছে এবং পরিবারের মধ্যে অর্থনৈতিক সংগ্রাম বাড়িয়ে তুলছে।
এ ধরনের অর্থনৈতিক চাপ প্রায়শই ক্যাটাস্ট্রফিক হেলথ এক্সপেন্ডিচার নামক একক দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়।
গবেষণায় বাংলাদেশের ক্যাটাস্ট্রফিক হেলথ এক্সপেন্ডিচার ও দারিদ্র্যের ওপর ব্যক্তির পকেট থেকে খরচের বিভিন্ন প্রভাব খোঁজা হয়েছে। এক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যয়ের ঘটনা, পকেট থেকে খরচের কারণে সৃষ্ট দারিদ্রতা ও আর্থিক সংকটের ওপর আলোকপাত করেছে গবেষণাটি।
গবেষণায় ওষুধ খরচ, পরামর্শ ফি, ডায়াগনস্টিকস, পরিবহন, থাকার ব্যবস্থা এবং নিজে ঔষধ কেনার মতো চিকিৎসাজনিত কারণে ব্যক্তির পকেট থেকে হওয়া ব্যয় নির্ণয় করতে ১৪ হাজারেরও বেশি ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
বিআইডিএস-এর মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন উল্লেখ করেন, গবেষণাটিতে কালীন সারি উপাত্ত বিশ্লেষণের পরিবর্তে মডেল সিমুলেশনের ওপর নির্ভর করা হয়েছে। ফলে গবেষণায় দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়া জনসংখ্যার হার শনাক্ত প্রকৃত পতনকে সঠিকভাবে প্রতিফলিত নাও করতে পারে।
তিনি অবশ্য বলেন, 'গবেষণা অনুসারে, আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, ব্যক্তির পকেট থেকে খরচবৃদ্ধি জনসংখ্যার একটি নির্দিষ্ট অংশকে দারিদ্র্যসীমার নীচে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করে।'
ক্যান্সার চিকিৎসায় পকেট থেকে বেশি খরচ
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২২ সালে স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়ে ব্যক্তির পকেট থেকে সবচেয়ে বেশি খরচ হয়েছে ক্যান্সার রোগীদের ক্ষেত্রে। ক্যান্সার রোগীদের নিজেদের পকেট থেকে বার্ষিক গড় খরচ হয় দুই লাখ ২৪ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ খরচ আট লাখ ৪৮ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়েছে।
কোভিড-১৯ সংক্রমণের শিকার রোগীদের গড় খরচ হয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার ৮০০ টাকা। এ ধরনের রোগীর সর্বোচ্চ খরচ ছয় লাখ ৪০ হাজার টাকা। নিউমোনিয়া ও জন্ডিসের পাশাপাশি হার্ট, কিডনি, লিভার ও মানসিক রোগের চিকিৎসায়ও উল্লেখযোগ্য খরচ করেছেন রোগীরা।
রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় তালিকায় শীর্ষে রয়েছে গর্ভাবস্থা-সম্পর্কিত ঘটনা। তারপরে শ্বাসযন্ত্রের অসুস্থতা, ডায়রিয়া এবং চোখের সমস্যার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী পাওয়া গেছে।
গবেষণা বলছে, প্রায় ১৮ শতাংশ পরিবার তাদের মোট খরচের ১০ শতাংশের বেশি খরচ করেন স্বাস্থ্যসেবার পেছনে। এছাড়া ৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ পরিবারকে তাদের খাবারের বাইরের ব্যয়ের মধ্যে ৪০ শতাংশ খরচ করতে হয় স্বাস্থ্যসেবার জন্য।
আব্দুর রাজ্জাক বলেন, 'স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়ের প্রায় ৬১ শতাংশ বন্ধু ও আত্মীয়দের সহায়তা থেকে এবং প্রায়শই ধার নেওয়া বা সম্পদ বিক্রির মতো দুর্যোগকালীন অর্থায়নের মাধ্যমে মেটানো হয়। এসব পরিবারের প্রায় ১৫ শতাংশ হাসপাতালে ভর্তির খরচ মেটাতে সম্পদ বিক্রি করেছে।
'বাকি খরচের ৩৩ শতাংশ আসে সঞ্চয় থেকে। আর বাকি ৬ শতাংশ নিয়মিত আয় থেকে মেটানো হয়।'
বিনায়ক সেন বৈষম্যের ওপর ব্যক্তির পকেট থেকে খরচের প্রভাব সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, 'আমাদের জিনি সহগ [কোনো জনসংখ্যার অর্থনৈতিক বৈষম্যের পরিসংখ্যানগত পরিমাপ] এসব ব্যয়ের কারণে পরিবর্তিত হচ্ছে কি না তা আমাদের বের করা উচিত।'
তিনি রক্ত পরীক্ষায় বিভিন্ন হাসপাতালে খরচের বড় তারতম্যের মতো হাসপাতালভেদে রোগ নির্ণয়ের খরচের বৈষম্যর কথা তুলে ধরে বলেন, এ পার্থক্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
শুধু বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা খাতে বরাদ্দ বাড়ালে হবে না, বরং এ বিষয়গুলোও ভেবে দেখতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সরকার জাতীয় স্বাস্থ্যবিমার পরিকল্পনা করছে: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বলেন, 'বিশ্বব্যাপী অনেক দেশ সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমা রয়েছে। ভারতও কয়েক বছর আগে এ বিমা চালু করেছে। আমরা এখন একই ধরনের স্বাস্থ্যবিমা চালু করার পরিকল্পনা করছি।
'গত ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তরবঙ্গের বেশ কয়েকটি জেলা ও কমিউনিটি হাসপাতাল আমি ঘুরে দেখেছি। গ্রামেগঞ্জে প্রসূতি মায়েদের যে পরিমাণ কষ্ট, তা চোখে দেখা যায় না। আমি তাই আগে গ্রামের এ সমস্যাগুলো সমাধান করতে চাই।'
মন্ত্রী বলেন, হাসপাতালে আসা রোগীদের একটি বড় অংশ উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে ভুগছেন। এগুলোর কারণে হৃদরোগ ও কিডনির বড় অসুখগুলো হয়। 'আমাদের তাই এ ধরনের রোগীর সংখ্যা কমানোর জন্য সচেষ্ট হতে হবে।'
স্বাস্থ্য বাজেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমরা স্বাস্থ্যখাতের বাজেটের টাকা ঠিকমতো ব্যবহার করতে জানি না। ভালোমতো ব্যবহার করলে এ বাজেটেই অনেক ভালো সেবা দেওয়া সম্ভব।'
জাতীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন নিয়ে চলমান কাজের কথা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, 'আমরা আইনটি চূড়ান্ত করতে গত ছয় মাসে অন্তত সাতটি বৈঠক করেছি। এ আইনটি আমার মেয়াদ থাকাকালীন করে যেতে চাই।'
তিনি অবৈধ ফার্মেসির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, 'অবৈধ ফার্মেসি আমাদের এখানে অনেক আছে। এদেরকে থামাতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে আরও উদ্যোগী হতে হবে।'