জটিল রোগ চিকিৎসায় বিদেশমুখীতা কমাতে দেশের স্বাস্থ্যখাতে সামর্থ্য বাড়ানোর পরিকল্পনা
বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসা করাতে বাংলাদেশের রোগীদের বিদেশমুখীতা দিনে দিনে বাড়ছে। তাই ক্যান্সার, হৃদযন্ত্র, অনুর্বরতা ও কিডনির সমস্যার মতো জটিল ব্যাধির চিকিৎসা সেবা যেন দেশেই পাওয়া যায়— সেই লক্ষ্যে কৌশলগত কিছু পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সরকার।
জটিল এই চার ধরনের অসুস্থতার চিকিৎসায় দেশের স্বাস্থ্য সেবায় যেসব ঘাটতি রয়েছে— তা পূরণে স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে এসব পদক্ষেপ নেওয়া হবে। যারমধ্যে থাকছে জাতীয়ভাবে সরকারি, অলাভজনক ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ।
গত ১৫ ডিসেম্বর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের প্রতিনিধি, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি সভা করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সেখানে কৌশলগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
সভায় বাংলাদেশিদের ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে ভারতের বিধিনিষেধ নিয়েও আলোচনা হয়। সেখানে উপস্থিত চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভিসা নিয়ে সমস্যার কারণে রোগীরা যেতে পারছেন না, এতে করে ক্যান্সার, কিডনি, ইনফার্টিলিটি ও কিছু ক্ষেত্রে কার্ডিয়াক রোগীদের সমস্যা হচ্ছে। তাই স্থানীয়ভাবে এই চার ধরনের অসুস্থতার চিকিৎসা ঘাটতির সমাধানে সরকারি, বেসরকারি ও অলাভজনক হাসপাতালগুলোকে নিয়ে একটি জাতীয় উদ্যোগ নিতে পারে অন্তর্বর্তী সরকার।
সভায় উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, 'চারটা ডিজিজকে আমরা টার্গেট করেছি যেগুলোর চিকিৎসা করাতে রোগীরা সাধারণত বিদেশে যায়। আমরা দুটি মূল দুটি বিষয়: অ্যাকচুয়াল টেকনিক্যাল রিজন ও দক্ষতার ঘাটতি আছে। ক্যান্সার ও ট্রান্সপ্ল্যান্টের ক্ষেত্রে রেডিওথেরাপি মেশিনের মতো সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। আর কিছু আছে পারসেপশন। লোকজন ধারণা করে বিদেশে ভালো চিকিৎসা হয়।'
তিনি আরও বলেন, প্রকৃত সমস্যাটা একভাবে আর ধারণাটা অন্যভাবে সমাধান করতে হবে। 'প্রকৃত সমস্যার সমাধানে আমাদের যে সামর্থ্য আছে– সেটি বাড়াতে হবে। হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট ও আর্টিফিশায়াল হার্ট ছাড়া কার্ডিয়াকে আমাদের সামর্থ্য ভারতের মতই। বাকি তিন জায়গায় আমাদের অ্যাকচুয়াল সমস্যা আছে।'
গ্লোবোক্যান ২০২০ রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতিবছর বাংলাদেশে ১ লাখ ৫৬ হাজার জনের দেহে ক্যান্সার শনাক্ত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানদণ্ড প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য অন্তত একটি রেডিওথেরাপি মেশিন রাখার পরামর্শ দেয়; সেই হিসাবে, বাংলাদেশের ৩০০টি এই মেশিন দরকার। কিন্তু, বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে রেডিওথেরাপি মেশিন রয়েছে মাত্র ৩৭টি, যার বেশিরভাগই আবার অচল।
ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, প্রতি বছর ২৫ লাখ বাংলাদেশি মেডিকেল টুরিস্ট ভারতে যায়, সেখানে তারা চিকিৎসা বাবদ ব্যয় করেন প্রায় ৫০ কোটি ডলার।
পরিকল্পনার অধীনে প্রস্তাবিত পদক্ষেপগুলো কী
ডা. সায়েদুর রহমান জানান, 'ক্যান্সার চিকিৎসায় যন্ত্রপাতি ও ওষুধ আমদানিতে কর রেয়াতের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে।'
মধ্য মেয়াদে আগামী ৬-১২ মাসের মধ্যে ৮ বিভাগে ৮টি ক্যান্সার হাসপাতাল ও ডায়ালাইসিস সেন্টার চালু করাও পরিকল্পনায় রয়েছে বলে জানান তিনি। প্রতিটি হাসপাতাল ১০০ শয্যার হবে। এছাড়া, ৭৫০ বেডের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল (বিএসএমএমইউ) বর্তমানে সক্ষমতার মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবহার করা হচ্ছে। এ হাসপাতালকে পুরোদমে চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, আগামী মাস থেকে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে কর্মরত কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট-সহ এই চারটি রোগের বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞরা বিএসএমএমইউ সুপারস্পেশালাইড হাসপাতালে আসা শুরু করবে। তাদের ছুটির সময়ের সাথে মিলিয়ে এখানে আসবে। তারা কাজ শুরু করলে ইমেজ বিল্ডিং (ভাবমূর্তি গড়ে তোলা) ও কনফিডেন্স বিল্ডিংয়ে (আস্থা বাড়াতে) কাজ করবে। এখানে মূলত কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টে বেশি জোর দেয়া হবে।
সরকার কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট আইন পরিবর্তনের কথা ভাবছে বলেও জানান তিনি।
বর্তমানে, মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন (সংশোধন) আইন, ২০১৮ অনুয়ায়ী জীবনরক্ষায় নিকটাত্মীয়ের কিডনি নেওয়া যাবে। এ আইনের কারণে নিকটাত্মীয়ের কিডনির অভাবে অনেক রোগী দেশে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে না পেরে– বিদেশে গিয়ে অনেক বেশি টাকা ব্যয় করে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করে। অনেক ক্ষেত্রে প্রতারিত হয়, কিডনি দাতারাও ফলোআপ করতে না পেরে– অনেক সময় অসুস্থ্য হয়ে মারা যায়। দীর্ঘদিন ধরে এ আইন পরিবর্তনের দাবি করছে বিশেষজ্ঞরা।
ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, "সোয়াপ ট্রান্সপ্ল্যান্ট এর সুবিধার্থে আইনে 'নিকটআত্মীয়' নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হবে। ন্যাশনাল অরগান ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হবে। সেখানে যারা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করতে চান— তাঁদের তথ্য ডেটা ব্যাংকের সাথে ম্যাচ করে দেখা হবে।"
তিনি বলেন, 'ট্রান্সপ্ল্যান্ট ট্রেনিংয়ের জন্য আমরা একটি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা যদি রাজি হয়, এখানে এসে ট্রেনিং দিইয়ে যাবে, নয়তো আমাদের টিম ওদের দেশে যাবে। আমরা কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের ৫-১০টা টিম তৈরি করতে চাই।'
এদিকে সভায় উপস্থিত একাধিক ব্যক্তি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলোর কাছে তুলনামূলক খরচ জানতে চেয়েছে সরকার। অর্থাৎ, তাদের খরচের চেয়ে ভারতের বেসরকারি হাসপাতালের খরচের পার্থক্য এবং পেশেন্ট আউটকাম— যেমন রোগীর মৃত্যু হার কেমন, এবং কীভাবে তা আরও কমানো যায়।
তাঁরা জানান, সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ কমাতে দুই শিফট চালুর পরিকল্পনা করছে সরকার। পাশাপাশি মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সেন্টারের সক্ষমতা বাড়ানো হবে। গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালসহ অলাভজনক হাসপাতালগুলোর সাথে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে যাওয়ার পরিকল্পনাও করা হচ্ছে।
বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে এই বিশেষ পরিস্থিতিতে, অন্তত ৬ মাস মুনাফার ভিত্তিতে না চালানোর অনুরোধ করেছে সরকার। এছাড়া প্রতিবেশী যেসব দেশে কম খরচে চিকিৎসা পাওয়া যায় তাদের চিঠি দেয়া হয়েছে
'চিকিৎসকরা আন্তরিকভাবে কথা বলেন না'
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে– সেগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে খুবই ভালো হবে। তবে রোগীরা বিদেশে যায় মূলত যেসব কারণে তার মধ্যে অন্যতম হলো— ডাক্তারদের আন্তরিকভাবে কথা না বলা, রোগীকে সময় কম দেওয়া, ভুল ডায়াগনোসিস, সেবা পেতে নানান সমস্যা। চাইলেই এসব সমস্যা সমাধান করা যায়। এ বিষয়টি সরকার ও সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোকে দেখতে হবে।'
তিনি বলেন, সরকারি হাসপাতালে ডায়াগনোসিস দুপুরের পর বন্ধ হয়ে যায়, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের মাধ্যমে ডায়াগনোসিস সেবা সারাদিন দেওয়া যেতে পারে।
এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দেন, 'স্বল্প-মেয়াদে ডাক্তারদের ৬-৯ মাসের ট্রেনিং দিতে হবে— যাতে তাঁরা ক্যান্সারের চিকিৎসা করতে পারেন; পরবর্তীতে পোস্ট-গ্রাজুয়েশন করার সময় তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। এসব উদ্যোগ নেয়া গেলে রোগীদের বিদেশগামীতা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব'- বলে মনে করেন তিনি।
রোগীদের আস্থা বাড়াতে উদ্যোগ
দেশের চিকিৎসা সেবার ওপর দীর্ঘদিনের আস্থা সংকটের কারণেও রোগীরা বিদেশমুখী হন। ল্যাবএইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এ এম শামীম বলেন, 'ভারতে রোগী না যাওয়ায় আমাদের হাসপাতালে গত তিন মাসে অন্তত ১০ শতাংশ রোগী বেড়েছে।'
তিনি জানান, রোগীদের আস্থা বাড়াতে ৩২টি ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে ও চারটি হাসপাতালে ৮টি কাউন্সেলিং বুথ করেছে ল্যাবএইড। রোগীর আস্থা অর্জন, রোগীর কাছে যাওয়ার বিষয়ে পুরো জানুয়ারি মাসজুড়ে ডাক্তার, নার্স, পরিচর্যা কর্মী, রক্ত সংগ্রহের কর্মী, পরিচ্চন্নতা কর্মীসহ সাড়ে ৪ হাজার স্টাফকে প্রশিক্ষণ দেবে ল্যাবএইড। এছাড়া ল্যাবএইড ক্যান্সার হসপিটালে রোবোটিক সার্জারি, ক্যাথল্যাব আপগ্রেডসহ বিভিন্ন ধরনের উন্নত প্রযুক্তি সংযোজনে বিনিয়োগ করা হবে।
এভারকেয়ার হসপিটাল বাংলাদেশ লিমিটেডের পরিচালক (মেডিকেল সার্ভিসেস) আরিফ মাহমুদ টিবিএসকে বলেন, কোভিডের সময় দুই বছর রোগীরা বিদেশে যায়নি, বাংলাদেশের হাসপাতাল, ডাক্তারেরাই চিকিৎসা করছে।
তিনি বলেন, ঢাকা এভারকেয়ার হাসপাতাল ৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে। ৩ লাখ বর্গফুটের ওপিডি বিল্ডিং করা হবে। এখন ওপিডিতে দুই হাজার রোগী দেখা হয়, নতুন ভবনটিতে ৪-৫ হাজার রোগীকে সেবা দেওয়া যাবে। তবে এতে সময় লাগবে আরো দুই-তিন বছর। এখন ৩৬৫ বেড সার্ভিস দিচ্ছি – সেটি তখন ৬৫০ বেডের হবে।