ডিএমপি’র চিরুনি অভিযানে গ্রেপ্তার ২,৬৩০; ৮৫ শতাংশেরও বেশি শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে নাশকতার ঘটনায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) চিরুনি অভিযানে দুই হাজার ৬৩০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে ৮৫ শতাংশই শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ। বাকি ১৫ শতাংশ বিএনপি-জামায়াতসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশসহ শতাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় মেট্রোরেল, সেতু ভবন, বিটিভিসহ পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনা। এসব ঘটনায় বিএনপি ও জামায়াত-শিবির জড়িত দাবি করে চিরুনি অভিযান শুরু করে ডিএমপি।
ডিএমপি সূত্রে আরও জানা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনে নাশকতার ঘটনায় গত রবিবার পর্যন্ত ডিএমপি'র আটটি ডিভিশনে ২৪৩টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন দুই হাজার ৬৩০ জন। তাদের মধ্যে দুই হাজার ২৮৪ জনই সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থী। বাকি ৩৪৬ জনের মধ্যে বিএনপির নেতা-কর্মী রয়েছেন ২৬৯ জন, জামায়াত-শিবিরের ৭৩ জন, গণঅধিকার পরিষদের তিনজন ও জাতীয় পার্টির (জেপি-মঞ্জু) একজন রয়েছেন।
কোন ডিভিশনে কত মামলা
ডিএমপির রমনা ডিভিশনের ৩৮ মামলায় ১৪৭ জন, লালবাগে ১৭ মামলায় ২০৪ জন, মতিঝিলে ৩৬ মামলায় ৩৪৭ জন, ওয়ারীতে ৪৯ মামলায় ৫৯৪ জন, তেজগাঁওয়ে ২৫ মামলায় ২৯০ জন, মিরপুরে ২২ মামলায় ৪০৭ জন, উত্তরায় ২৬ মামলায় ২৫৮ জন, গুলশানে ৩০ মামলায় ৩৮৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ওয়ারী ডিভিশনে মামলা বেশি কেন
ডিএমপি'র আটটি ডিভিশনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ওয়ারীতে। এই বিভাগের আওতায় যাত্রাবাড়ী, গেন্ডারিয়া, কদমতলী, শ্যামপুর, ডেমরা এবং ওয়ারী থানা রয়েছে। এসব থানায় সর্বমোট ৪৯টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছে ৫৯৪ জন। যার মধ্যে ৫৪৬ জনই সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থী।
মামলার বিষয়ে কথা হয় ওয়ারী ডিভিশনের উপ-কমিশনার ইকবাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, কোটাবিরোধী আন্দোলনে এ ডিভিশনে সবচেয়ে বেশি নাশকতা হয়েছে। টোলপ্লাজা, পুলিশ হত্যা, দলীয় কার্যালয় পোড়ানো, পুলিশ সদস্যদের নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। যে কারণে মামলা বেশি হয়েছে।
সাধারণ মানুষ গ্রেপ্তারের বিষয়ে তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'নাশকতায় সব ধরনের মানুষ যুক্ত ছিল। আমরা গণহারে গ্রেপ্তার করছি না। নাশকতার সঙ্গে সম্পৃক্ততা দেখেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।'
'নাশকতায় জড়িতদের বেশিরভাগই ছিল বহিরাগত। এদের কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ থেকে ভাড়া করে আনা হয়েছে', যোগ করেন তিনি।
পুলিশের মামলায় গুলির কথা উল্লেখ নেই
কোটাবিরোধী আন্দোলনে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলি ছোড়ে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সংঘর্ষে পুলিশসহ প্রাণ হারায় ১৫০ জন। তবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবি- সংঘর্ষে ২৬৬ জন মারা গেছে। যাদের বেশিরভাগই ছিল গুলিবিদ্ধ। তবে পুলিশের দায়ের মামলায় গুলিতে নিহত হওয়ার কোনো তথ্য নেই। দুয়েকটি মামলায় শটগান থেকে ফাঁকা গুলির কথা বললেও সেই গুলিতে কারও মারা যাওয়ার কথা বলা হয়নি।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় টানা চারদিন সংঘর্ষ চলে। এ সময় বেশ কয়েকজন হতাহত। যাদের বেশিরভাগের শরীরে গুলিবিদ্ধ হওয়ার চিহ্ন দেখা গেছে। তবে পুলিশের দায়ের করা মামলার এজহারে গুলি বিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার বিষয়টি নাই। যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশের ওয়ারী ডিভিশনের আওতাধীন।
জানতে চাইলে ওয়ারী ডিভিশনের উপ-কমিশনার (ডিসি) ইকবাল হোসেন বলেন, 'পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ফাঁকা গুলি ছুঁড়েছে। তবে এতে কেউ মারা গেছে কি না, তা নিশ্চিত নয়। যার কারণে মামলা এজাহারে উল্লেখ করা হয়নি।'
এ বিষয়ে ডিএমপি হেডকোয়ার্টারের এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, এজাহারে যখন সরাসরি গুলি আর মৃত্যু লেখা হবে, তখন সেটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত করে করতে হবে।
সিএমএম আদালতে স্বজনদের আহাজারি
এদিকে কয়েকদিন ধরে পুলিশের চিরুনি অভিযান চলছে। এতে গণহারে গ্রেপ্তারের অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। গত চারদিন সিএমএম আদালত প্রাঙ্গণের সংবাদ সংগ্রহ করেছেন টিবিএস'র এক প্রতিবেদক। এ সময় আদালত প্রাঙ্গণে আসা গ্রেপ্তারকৃতদের পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে কথা হয়।
তারা অভিযোগ করেন- পুলিশ বাসা-বাড়ি ও মেস থেকে নিরপরাধ ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করছে। ডিউটিতে থাকা ব্যক্তিদেরও গ্রেপ্তার করেছেন।
রাজিয়া বেগম (৩৯) তার একমাত্র সন্তান নিয়ে থাকেন হাতিরপুল এলাকায়। গত বুধবার তার ছেলে সায়েমকে (২১) সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
রাজিয়া বেগম টিবিএসকে জানান, তার ছেলে অ্যাম্বুলেন্স চালায়। ঘটনার দিন সে বাসা থেকে চা খেতে বের হয়েছিল। পুলিশ কোনো কারণ ছাড়াই তাকে গ্রেপ্তার করে।
সার্বিক বিষয়ে ডিএমপির যুগ্ম-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার টিবিএসকে বলেন, 'আমরা সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই গ্রেপ্তার করেছি। এখানে শিক্ষার্থীদের কোনো হয়রানি করা হয়নি। বিএনপি, জামায়াত ও শিবিরের সন্ত্রাসীদেরই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।