‘এই বাচ্চাদের দেখুন, তারা কীভাবে এটি সামাল দিচ্ছে’: ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় মুগ্ধ শহরবাসী
মো. শাহীন, রাজধানীর মগবাজার এলাকার বাসিন্দা, যখন তিনি শুনেন যে রাস্তার গাড়ি-ঘোড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য ট্রাফিক পুলিশ নেই, তিনি শঙ্কিত হয়ে গিয়েছিলেন।
তবে তার এ শঙ্কিত হওয়া কিন্তু অমূলক নয়। কারণ ঢাকা তার যানজটের জন্য বিখ্যাত। যার কারণে গত বছর একটি বৈশ্বিক ট্রাফিক সূচকে পঞ্চম স্থান অর্জন করে ঢাকা। এমনকি একটি ভালো দিনেও এ বিশাল শহরে অসহনীয় যানজট লেগেই থাকে।
যানজট নিয়ে শঙ্কিত শাহীন যখন বাড়ি থেকে বের হলেন, তিনি অবাক হয়ে গেলেন। তিনি বলেন, "প্রথমে আমি চিন্তিত ছিলাম যে ট্রাফিক ব্যবস্থার কী হবে। কিন্তু দেখুন এই বাচ্চাদের, কীভাবে তারা এটি সামাল দিচ্ছে।"
তরুণদের এই দক্ষতা কেবলমাত্র তাকে মুগ্ধই করেনি, বরং ট্রাফিক নিয়ম মেনে চলার প্রতি আরও আগ্রহী করে তুলেছে। মগবাজার মোড়ে দাড়িয়েই দ্যা বিজনেস স্টান্ডার্ড প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলছিলেন শাহীন। তিনি এ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, "আমি তাদের নিয়ে গর্বিত। তারা ট্রাফিক পরিস্থিতির উন্নতির জন্য যে নিয়মগুলো তৈরি করেছে, সেগুলো অনুসরণ করা আমাদের দায়িত্ব।"
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পথ ধরে গণআন্দোলন গড়ে ওঠে তার জেরে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। আন্দোলনে পুলিশের ওপর আক্রমণসহ বিদ্যমান অস্থিরতার কারণে মাঠে নেই পুলিশ। যার কারণে যানজট নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশরাও মাঠে নেই।
তাই ট্রাফিক পুলিশদের অভাব পূরণ ও শহরগুলো পরিষ্কার করতে ছাত্ররা আবারও রাস্তায় নেমে এসেছে। তাদের এ প্রচেষ্টা দেশব্যাপী মানুষের কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে দাড়িয়েছে।
মগবাজার মোড়ে দাড়িয়ে থাকা আরেক পথচারী বলেন, "ছোটদের এ কাজের জন্য তাদের আমি স্যালুট জানাতে চাই। আমি অত্যন্ত গর্বিত এবং আমি আন্তরিকভাবে সবার কাছে অনুরোধ করছি, তারা যেন তরুণদের অনুসরণ করেন। তবে আন্দোলনে যে প্রাণ হারিয়েছে তাদের জন্য আমি দুঃখিত।"
তবে শুধু পথচারীরাই নয়, ছাত্রদের এ প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, রাজনৈতিক দল এবং নেটিজেনরাও।
রাস্তায় দাড়িয়ে শহরের যানজট নিয়ন্ত্রণ ছাত্রদের জন্য নতুন কিছু নয়। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়ও ছাত্ররা যানজন নিয়ন্ত্রণে রাস্তায় নেমে এসেছিল। সেসময় তাদের প্রচেষ্টা বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের কাছে প্রশংসিতও হয়েছিল।
এবারও এ তরুণদের প্রচেষ্টা অনেককে আকৃষ্ট করেছ, এমনকি যারা কখনো চিন্তাও করেনি তারাও কাজ করছে। তেমনিই এক তরুণ হলেন সিরাজুল ইসলাম। তিনি কানাডার সাইমন ফ্রেজার ইউনিভার্সিটির ছাত্র। মগবাজারে যানজট নিয়ন্ত্রণে কাজ করার সময় তিনি বলেন, "আমি ঘরের মধ্যে বসে থাকতে পারছিলাম না।"
সিরাজুল ইসলাম জানান, তিনি ছাত্র আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বলেন, "আমি এটি উপভোগ করেছি এবং একটি ভালো দেশের আশা করছি। আর প্রতিটি ছোট পদক্ষেপ থেকেই ছোট ছোট পরিবর্তন আসবে।"
মগবাজার এলাকায় স্থানীয় শিক্ষার্থীরাসহ দূরবর্তী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও সহযোগিতা করতে এসেছিল।
এ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিলেন সিদ্ধেশ্বরী গার্লস হাই স্কুলের মুশফিকা এবং মালিহা। যানবাহন নিয়ন্ত্রণে সবটা সময় থাকায় তাদের মধ্যে একই সঙ্গে আনন্দ ও উদ্বেগ বিরাজ করছিল। তারা বলেন, "মানুষের আচরণ দেখে আমরা একইসাথে আনন্দিত এবং দুঃখিত। আমরা অবাক হয়ে গিয়েছি, অনেকেই জেব্রা ক্রসিং কী তা জানে না, তবে আমরা আশাবাদী। আস্তে আস্তে এবং ধৈর্য নিয়ে শেখালে, মানুষ শিখছে এবং সহযোগিতা করছে।
ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের এ ক্যাম্পেইনে ঢাকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও সমর্থন রয়েছে। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদিক জানান, প্রথচারীদের ব্যবহারে তিনি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন। তিনি বলেন, "আজ, আমি দেখলাম শত শত মানুষ রাস্তা পার হচ্ছেন শুধুমাত্র হাত তুলে। আমরা সবাই তাদেরকে নিয়ম মেনে চলার অনুরোধ করেছি। তিনি আরো বলেন, 'আমরা নম্র কিন্তু দৃঢ় ভাবেই সবাইকে নিয়ম মেনে চরার জন্য উদ্বুদ্ধ করছি।
আরেক বিশ্ববিদ্যালয় আরেক শিক্ষার্থী সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিব এ পরিবর্তনকে ধীর গতির বললেও, তিনি আশাবাদী। তিনি বলেন, "নিশ্চিতভাবেই, এটি একটি কঠিন কাজ। সবাই শুনছে না। কারণ, মানুষ এতটার অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, যে ট্রাফিক নিয়ম ভাঙাই তাদের জন্য স্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু আমরা আশা হারাচ্ছি না। কিছুটা সময় লাগতে পারে, তবে প্রতি ছোট পদক্ষেপই ছোট পরিবর্তন আনবে।"
মানুষ ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। ছাত্রজনতার বাইরে থেকেও শিক্ষার্থীরা সমর্থন পাচ্ছেন।
পান্থপথের সমরিতা হাসপাতাল থেকে মোটরসাইকেলে করে মগবাজারে এসছেন ডা. নকিব ও ডা. সাইদুল। তারা ছাত্রদের জন্য বিস্কুট ও কেক নিয়ে এসেছিলেন। তারা হাসিমুখে বলেন, "আমরা আমাদের প্রিয় ছাত্রদের সমর্থন করতে এসেছি।"
শিক্ষার্থীদের এ কার্যক্রমের প্রভাব রিকশা ও সিএনজি চালকদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে।
মগবাজার এলাকার রিকশা চালক সদন চন্দ্র শিক্ষার্থীদের সমর্থন করে বলেন, "আমি তাদের সমর্থন করি এবং আমাদের সবার উচিত তাদের কথা মেনে চলা। ট্রাফিক পুলিশদের আচরণের কারণে রিকশা চালকরা বিরক্ত। কিন্তু দেখুন ছাত্রদের—তারা আমাদের সাথে হাসিমুখে কথা বলে।" মোহাম্মদপুর এলাকার সিএনজি চালক মোহাম্মদ রিপনও একই অনুভূতি প্রকাশ করেন। রিপন বলেন, "মনে হয় এই প্রথম আমি তাদের নিয়ম মেনে রাস্তায় গাড়ি চালানো উপভোগ করছি। আমি প্রার্থনা করছি আর কোনো প্রাণহানি যেন না ঘটে।"
তবে, এ পরিবর্তনের স্থায়িত্ব নিয়ে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
আরেক রিকশা চালক আনোয়ারুল ইসলাম এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলেন। তিনি বলেন, "এখন ছাত্ররা আছেন, তাই সবাই তাদের কথা শুনছে, কিন্তু যখন তারা থাকবে না, তখন এসব নিয়মের কী হবে?"