২০০১ সালে লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টা ছিলেন যারা
২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়েছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান। ওই বছরের ১৫ জুলাই এ সরকার শপথ গ্রহণ করে। এতে প্রধান উপদেষ্টাসহ মোট উপদেষ্টা ছিলেন ১১ জন।
১. সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান
তত্ত্বাবধায়ক সরকারে তিনি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, সংস্থাপন, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
লতিফুর রহমানের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১ মার্চ যশোরে। তার বাবা ছিলেন একজন আইনজীবী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি লাভের পরে– তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনেও ডিগ্রি নেন। ১৯৬০ সালে যোগ দেন ঢাকা হাইকোর্টে। ১৯৯০ সালের ১৫ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারক হিসেবে শপথ নেন। সবশেষে প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসর নেন ২০০০ সালের ১ জানুয়ারি। ওই বছরের ১ মার্চ অবসর গ্রহণ করেন।
২. বিচারপতি বিমলেন্দু বিকাশ রায় চৌধুরী
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিচারপতি বিমলেন্দু বিকাশ রায় চৌধুরী।
তিনি ১৯৩৫ সালের ১ নভেম্বর চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জে এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
বিমলেন্দু বিকাশ রায় চৌধুরী প্রথমে তার পিতামহের প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় একটি স্কুলে, পরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়াশোনা করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স এবং এলএলবি ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬২ সালে তিনি তৎকালীন ঢাকা হাইকোর্টে এবং ১৯৬৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টে এডভোকেট হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৮০ সালে তিনি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্ত হন।
৩. রোকেয়া আফজাল রহমান
রোকেয়া আফজাল রহমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মহিলা ও শিশু, সমাজকল্যাণ, শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম খন্দকার আলী আফজাল বেঙ্গল আইনসভার সচিব এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের যুগ্মসচিব ছিলেন। তার পিতামহ খান বাহাদুর ফজলে রাব্বী বৃটিশ আমলে মুর্শিদাবাদের দেওয়ান ছিলেন। তার স্বামী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আজিমুর রহমান আরলিংকস গ্রুপ, ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো প্রকাশনা গ্রুপের চেয়ারম্যান ছিলেন।
৪. মেজর জেনারেল (অব.) মইনুল হোসেন চৌধুরী
মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অব.) বীর বিক্রম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, ডাক ও টেলিযোগাযোগ উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। জনাব চৌধুরী ১৯৪৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালে তিনি প্রথম ১০ জনের মধ্য থেকে কমিশন লাভ করেন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পদাতিক ডিভিশনে যোগ দেন।
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে অংশ নিয়ে তিনি অপারেশন এন্ড সার্ভিস পদক লাভ করেন। ১৯৬৮ সালে মইনুল হোসেন ইনফ্যান্ট্রি স্কুলের প্রশিক্ষক নিযুক্ত হন ১৯৬৯-৭০ সালে তিনি ঢাকার জিওসি এবং সামরিক আইন প্রশাসরে এডিসি ছিলেন। ১৯৭০ সালে তিনি মেজর পদে উন্নীত হন।
৭১ সালে জয়দেবপুর সেনানিবাস থেকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং আগস্ট পর্যন্ত দেশের ভেতরে থেকে একটি নিয়মিত ও অনিয়মিত বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি একটি নিয়মিত পদাতিক ব্যাটালিয়নের কমান্ডার ছিলেন।
মাঠে থেকে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য তিনি বীর বিক্রম উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেওয়া ক্যাম্পেইন স্টার, অপারেশন মেডেল, ইন্ডিপেনডেন্স মেডেলসহ সবকটি পদকই পেয়েছেন তিনি।
৫. সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী দ্বিতীয়বারের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারে তিনি যোগাযোগ, নৌ পরিবহন, বেসামরিক বিমান পরিবহন, পর্যটন, ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। এরপরে ২০০১ সালে পালন করেন কৃষি, নৌ পরিবহন, মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব।
তিনি ১৯৪২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম স্যার সৈয়দ নাসিম আলী ১৯৪৬ সালে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন তিনি এক পুত্র ও এক কন্যার জনক। তার স্ত্রী মিসেস নীলুফার মঞ্জুর ঢাকার সানবিম স্কুলের প্রিন্সিপাল।
৬. এম. হাফিজউদ্দিন খান
এম হাফিজউদ্দিন খান তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অর্থ, পরিকল্পনা, পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩৯ সালের ৮ আগস্ট সিরাজগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার রহমতগঞ্জ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম কোব্বাদ আলী একজন শিক্ষক, বিদ্যোৎসাহী ও সমাজসেবক ছিলেন। জনাব হাফিজউদ্দিন ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্সসহ এমএ পাশ করেন।
১৯৬৫ সালে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান সেন্ট্রাল পাবলিক সার্ভিস নি কমিশনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে পাকিস্তান রেলওয়ে একাউন্টস সার্ভিসে যোগ দেন। পরে তিনি যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানীয় সরকার স্টাডিজ ইনস্টিটিউট থেকে ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্সের ওপর ডিপ্লোমা করেন। এছাড়া তিনি দেশ ও বিদেশ থেকে ব্যাপক পেশাগত প্রশিক্ষণ লাভ করেন।
৭. এ কে এম আমানুল ইসলাম চৌধুরী
এ কে এম আমানুল ইসলাম চৌধুরী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩৮ সালের ২৪ মে তিনি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মরহুম হাফিজউদ্দিন চৌধুরীর পুত্র। জনাব চৌধুরী ১৯৫৮ সালে আহসানউল্লাহ প্রকৌশল কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে তড়িৎ প্রকৌশলে বিএসসি ডিগ্রী লাভ করেন। একই কলেজে তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগে প্রভাষক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু হয়।
তৎকালীন পাকিস্তান রেলওয়েজ ও টেলিগ্রাফ ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসের জন্য কেন্দ্রীয় প্রকৌশল সার্ভিস পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম স্থান লাভ করেন আমানুল ইসলাম চৌধুরী। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান টেলিফোন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-এর প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালন করেন। জনাব চৌধুরী ১৯৬২ সালে তৎকালীন পাকিস্তান রেলওয়ে সার্ভিসে শিক্ষানবিশ প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন।
তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৭ সালে তিনি বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯৯২ সালে সরকারের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে প্রেষণে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও পরে ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৫ সালে অবসর গ্রহণের পর এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়ে তিনি ডেসার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
৮. সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ
২০০১ সালে দ্বিতীয়বারের মতো এবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হন ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ। সপ্তম সংসদ নির্বাচনের সময় গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারে তিনি প্রথমবার উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। তবে প্রথমবার তিনি এই দায়িত্বের বাইরেও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন।
৯. ব্রিগেডিয়ার (অব.) অধ্যাপক আবদুল মালিক
ব্রিগেডিয়ার (অব.) আব্দুল মালিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ এবং ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯২৯ সালের ১ ডিসেম্বর সিলেট জেলার সদর উপজেলার পশ্চিম ভাগ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
১৯৫৪ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করার পর তিনি যুক্তরাজ্য থেকে এমআরসিপি, গ্লাসগো থেকে এফআরসিপি, এডিনবরা থেকে এফআরসিপি, বাংলাদেশ থেকে এফসিপিএস, যুক্তরাষ্ট্র থেকে এফসিসিপি ও এফএসিসি ডিগ্রী লাভ করেন।
১৯৫৫ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে মেডিক্যাল কোর-এ যোগদান করেন। ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন মেডিক্যাল ইউনিট এবং হাসপাতালে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান কার্ডিওলজিস্ট এবং মেডিসিনের ইন্সট্রাক্টর হিসেবে কাজ করেন।
ব্রিগেডিয়ার মালিক পরে পিজি হাসপাতালে যোগ দেন এবং সেখানে একটি কার্ডিয়াক ইউনিট প্রতিষ্ঠা করে অধ্যাপক হিসেবে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত সেখানে কাজ করেন। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৯ সালে অবসর গ্রহণের আগে পর্যন্ত তিনি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অবসর গ্রহণের পর তিনি বাংলাদেশ ও সার্কভুক্ত দেশগুলোর হৃদরোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। অধ্যাপক মালিক মিরপুরে অবস্থিত ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল সেক্রেটারি। তিনি বাংলাদেশ কার্ডিয়াক সোসাইটিরও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।
১০. আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী
আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তথ্য, গৃহায়ন ও গণপূর্ত, খাদ্য, পরিবেশ ও বন এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি মৌলভীবাজারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রভাষক হিসেবে তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেন।
১১. এ এস এম শাহজাহান
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন এ এস এম শাহজাহান। তিনি ১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী উপজেলার পদিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম আব্দুল আউয়াল তৎকালীন বৃটিশ-ইন্ডিয়া সরকারের একজন কর্মকর্তা ছিলেন।