কাজে আসছেন না আওয়ামীপন্থি চিকিৎসকরা, কর্মী সংকটে হাসপাতালগুলো
ক্ষমতা থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সহিংসতার ভয়ে আওয়ামীপন্থি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা কর্মস্থল এড়িয়ে যাওয়ায় সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে উল্লেখযোগ্য কর্মী সংকট দেখা দিয়েছে।
অনেক হাসপাতালের কার্যক্রম, বিশেষ করে আউটডোরের কার্যক্রম চলছে অর্ধেক জনবল দিয়ে। তবে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের পর শনিবার (১০ আগস্ট) থেকে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকের উপস্থিতি বাড়বে বলে আশা করছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকরা।
স্বাস্থ্য সেবা অধিদপ্তরের একটি রিয়েল-টাইম ড্যাশবোর্ডে চিকিৎসকদের প্রতিদিনের উপস্থিতির তথ্য থাকে। মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) ড্যাশবোর্ড ডাউন থাকায় অনুপস্থিত চিকিৎসকের সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৫০ শতাংশের বেশি ডাক্তার অনুপস্থিত ছিলেন।
ঢাকা মেডিক্যালের মেডিসিন বিভাগের আউটডোরে গতকাল (৮ আগস্ট) দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র চার জন চিকিৎসক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের এক চিকিৎসক বলেন, "যারা কোন দলের সাথে যুক্ত না, তেমন চিকিৎসকরাই বর্তমানে হাসপাতালে ডিউটি পালন করছে। আমাদের বিভাগের অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক সহ বিভিন্ন পদের অনেক চিকিৎসক বর্তমানে হাসপাতালে আসছেন না। আমাদের ডিপার্টমেন্টে বর্তমানে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ চিকিৎসক অনুপস্থিত থাকছেন।"
তিনি আরো বলেন, "আওয়ামীপন্থি এসব চিকিৎসক বিরোধীদের আক্রমণের ভয়ে অনুপস্থিত আছেন। হাসপাতালে সব বিভাগে এখন চিকিৎসক কম। তবে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের পর পরিস্থিতি হয়ত স্বাভাবিক হবে বলে আশা করছি।"
হৃদরোগের চিকিৎসায় দেশের একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতাল ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ। সেখানেও আওয়ামীপন্থি চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি হাসপাতালে দায়িত্ব পালনকারী বাকি চিকিৎসকদের কাজের চাপ বাড়িয়েছে।
একইভাবে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করার জন্য পরিচিত অনেক জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) অনুপস্থিত থাকছেন।
সরকার পতনের পর থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য, উপ- উপাচার্য, রেজিস্টারসহ বিভিন্ন বিভাগের চেয়ারম্যান, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা হাসপাতালে যাচ্ছেন না। তবে বৃহস্পতিবার থেকে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পরিচালক (হাসপাতাল) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজাউর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সাম্প্রতিক দিনের তুলনায় বৃহস্পতিবার কর্মীদের উপস্থিতি অনেক ভালো ছিল।
তিনি বলেন, "আমরা এখনো শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে না পারলেও পরিস্থিতি আগের থেকে অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। আজ (বৃহস্পতিবার) আমাদের হাসপাতালের সব অপারেশন থিয়েটার চালু ছিল। সকালের ও বিকেলের আউটডোরে পর্যাপ্ত রোগী ছিল। আশা করছি শনিবারে চিকিৎসকদের উপস্থিতি আরো বেড়ে যাবে।"
তিনি আরো বলেন, "প্রশাসনিক ভবনের অনেক রুম খোলা ছিল। ভাইস চ্যান্সেলরসহ প্রশাসনিক অনেকেই বাসা থেকে কাজ করেছেন। পরিস্থিতি সহনীয় পর্যায়ে আছে এবং কোন রোগী চিকিৎসা না পেয়ে ফেরত গেছে, এমন ঘটনা ঘটেনি।"
ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতেও একই অবস্থা। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (আরএমসিএইচ) উত্তরবঙ্গের মধ্যে অন্যতম প্রধান হাসপাতাল। এই হাসপাতালে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে রোগী এসে চিকিৎসা নেন। গত ৫ আগস্টের সংঘর্ষে আহত হয়ে প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
তবে সরকার পতনের পর থেকে আওয়ামীপন্থি বহু চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তারা হাসপাতালে আসছেন না। এছাড়া সংখ্যালঘু অনেক চিকিৎসক হাসপাতালে আসছেন না বলে জানা গেছে।
চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তার উপস্থিতি কম হওয়াতে হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ইনচার্জ ডা. শংকর কে বিশ্বাস।
তিনি বলেন, "স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে হাসপাতালে এখন অর্ধেক রোগী আসছে। অন্য স্বাভাবিক সময়ে যেখানে ১২০০ থেকে ১৪০০ রোগী হাসপাতালে ভর্তি থাকে সেখানে গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে মাত্র ৭০৩ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। রোগী কম আসায় সেবা দিতে সমস্যা হচ্ছে না।"
তিনি আরো বলেন, এছাড়া দুই সপ্তাহ আগে নতুন ইন্টার্ন চিকিৎসক হাসপাতালে আসায় তাদের সবাইকে কাজে লাগানো যাচ্ছে।"
এছাড়া ল্যাব, প্যাথলজি ও হাসপাতালের অন্যান্য সেবা স্বাভাবিক নিয়মেই চলছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
সরকার পতনের সাথে সাথেই সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম।
জানা যায়, শেখ হাসিনার পদত্যাগের দিনই একদল দুর্বৃত্ত মিছিল নিয়ে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ও উপ পরিচালকসহ উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের কক্ষ ও কক্ষের সামনে ভাঙচুর চালায়। এছাড়া হাসপাতালের বঙ্গবন্ধু কর্নারেও ভাঙচুর চালানো হয়।
সেদিনের পর থেকেই হাসপাতালের উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তা ভয়ে হাসপাতালে আসছেন না। এছাড়া আওয়ামীপন্থি হিসেবে পরিচিত চিকিৎসকরা হাসপাতালে না আসায় চিকিৎসা সেবা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে ভর্তি থাকা এক রোগীর স্বজন সাইদুল ইসলাম বলেন, এখন হাসপাতালে ডাক্তারের সংখ্যা কমে যাওয়ায় চিকিৎসাসেবা পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে। এছাড়া হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়ার পরিমাণ কমে গেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এই ব্যাপারে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার মাহবুবুল হক ভুঁঞার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও সম্ভব হয়নি।
বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের (শজিমেক) উপপরিচালক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ জানিয়েছেন, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই হাসপাতালে এখনো কোনো সংকট তৈরি হয়নি।
তিনি বলেন, "আমরা বেশি করে সেবা দিচ্ছি। এখনো আমাদের এখানে অন্তত ১২৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি রয়েছেন। তাদের খুব গুরুত্বসহকারে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে।"
টিবিএস-এর রাজশাহী প্রতিনিধি বুলবুল হাবিব, সিলেট প্রতিনিধি দেবাশিস দেবু এবং উত্তরবঙ্গ ব্যুরো প্রধান খোরশেদ আলম প্রতিবেদন তৈরিতে অবদান রেখেছেন।