রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রকল্প আর থাকবে না: পরিকল্পনা উপদেষ্টা
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বা গোষ্ঠী স্বার্থে নেওয়া প্রকল্প যাছাই-বাছাই শেষে ছাটাই করা হবে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
সোমবার (১৯ আগস্ট) শেরে বাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে পরিকল্পনা কমিশন ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিং শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, প্রত্যেক প্রকল্প, "যাছাই –বাছাই করা অত্যন্ত প্রয়োজন। কারণ এখানে অনেক বিশৃঙ্খলা রয়েছে। কিছু রয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে, নিজেদের নির্বাচনী এলাকার জন্য নেওয়া হয়েছে। এই ধরনের অনেক প্রকল্প এখনো জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদরের জন্য উত্থাপনের অপেক্ষা আছে। এসব প্রস্তাবিত প্রকল্প নতুন করে যাছাই-বাছাই করা হবে। এ ধরনের প্রকল্পে মাধ্যমে আসলে কতটুকু সুবিধা পাওয়া যাবে, সেগুলো খুব দ্রুত মূল্যায়ন করতে হবে এবং এগুলো ছাঁটাই করতে হবে।"
তিনি বলেন, "কিছু প্রকল্পে এখনো শুরুই হয়নি। কিছু বাস্তবায়নের মাঝ পথে আছে। আবার কিছু সমাপ্তির পথে আছে। সব চলমান প্রকল্পই রেখে দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। চলমান প্রকল্পের মধ্যে যেগুলো বাস্তবায়নের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, এবং যদি মনে হয় এগুলো অপচয়মূলক, এবং এগুলো দিয়ে কোনো লাভ হবে না, এ ধরনের প্রকল্প বাদ দিয়ে দেওয়াই ভালো। এক্ষেত্রে কিছু অর্থ ব্যয় হলেও তা সহ্য করা (মেনে নেওয়া) হবে। এর লক্ষ্যে পরীক্ষা–নিরিক্ষার কাজ খুব দ্রুত করতে হবে।"
পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, "চলমান কোনো প্রকল্পে কিছু অর্থ ব্যয় হয়ে গেলেই, ওই প্রকল্প শেষ করতেই হবে, অর্থনীতিতে এ যুক্তিতে খাটে না। এক্ষেত্রে অর্থনীতিতে যৌক্তিক বিবেচনা হলো, কত খরচ করেছি, তাতে কিছু আসে যায় না। বাকি কত খরচ করতে হবে এবং পুরো প্রকল্প থেকে সুবিধা পাওয়া যাবে কিনা, এটাই মূল বিষয়। অর্থনীতিতে এটা নিমজ্জিত ব্যয় বলা হয়।"
মেগা বা বড় প্রকল্পসব সব ক্ষেত্রে কৌশল নেওয়া হবে বলে জানান ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি আরো বলেন, "অর্থনীতিতে সময় একটা বড় বিষয়। প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, এখন যদি শেষ করতে চান, তাহলে অনেক প্রলম্বিত হবে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের কোন পর্যায়ে আছে তা বিবেচনা না করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে প্রকল্পগুলো নিয়ে, এগোবো নাকি এগোবো না।"
উদেষ্টা বলেন, "সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন ব্যয়ের বড় ভূমিকা আছে। এখন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা প্রয়াজন। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতিকে কমিয়ে আনতে হবে। এখন সরকারি ব্যয় সংকোচন করা প্রয়োজন। ব্যয় সংকোচন করতে গেলে সবচেয়ে সহজ হলো উন্নয়ন ব্যয়টা কমানো। আমাদের দেখতে হবে, ঘাটতি বাজেট যাতে না হয় এবং মূল্যস্ফীতি যেন কমিয়ে আনা যায়।"
তিনি বলেন, "বৈদেশিক অর্থায়নের অনেক প্রকল্প, উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে ভুল বুঝাবুঝি আছে বলে, ওই প্রকল্পগুলোতে অর্থছাড় হচ্ছে না। এসব প্রকল্পে অর্থছাড় হলে বৈদেশিক আর্থিক সমস্যার সমাধান হবে।"
উন্নয়ন প্রকল্পে বিশৃঙ্খলার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে উপদেষ্টা বলেন, "অনেক প্রকল্প আছে, যেগুলোতে নকশাগত অনিয়ম, প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ অনেক অনিয়ম আছে। প্রকল্পের মেয়াদ ও সময় বৃদ্ধি বা নকশায় ভুল হওয়ার একটি কারণ হলো অদক্ষতা। আবার সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজসে ঠিকাদারদের দুর্নীতির কারণেও প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বাড়ে।"
তিনি বলেন, "আমরা জানি, অনেক প্রকল্প আছে বিশেষ করে— অবকাঠামো প্রকলপ্, সেগুলো অনেক কম খরচে বাস্তবায়ন করা যেতো। কিন্ত উপযুক্ত মূল্যায়ন না হওয়া এবং যথাযথভাবে বাস্তবায়নের না হওয়া এবং নকশার ত্রুটির কারণে প্রকল্পগুলো বহুবার সংশোধন করতে হয়েছে। নকশা পরিবর্তন ছাড়াও বহুবার ব্যয় ও মেয়াদ সংশোধন করতে হয়েছে।"
বাংলাদেশের অনেক প্রকল্প আছে, ইউনিট প্রতি ব্যয় বিশ্বের অরেক দেশের চেয়ে বেশি। সড়ক অবকাঠামোসহ অন্যান্য অবকাঠামো প্রকল্পে এটা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, "অনেক প্রকল্পই কোনো কাজে আসবে কিনা তা বিবেচনা না করেই মন্ত্রণালয়গুলো থেকে পাঠানো হয়, এসব প্রকল্পের ক্ষেত্রে দেশীয় ঠিকাদারদের রাজনৈতিক প্রভাব থাকে। যে কারণে দেখা যায় অনেক অবকাঠামো নির্মাণ শেষ হলেও বছরে পর বছর ব্যবহার ছাড়াই পড়ে আছে। নতুন করে এ ধরনের প্রকল্প যাতে না আসে, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। আর যে অবকাঠামোগুলো হয়ে গেছে, সেখানে জনবলের জন্য কিছু বরাদ্দ দিয়ে, সেগুলো চালু করা যায় কিনা তা দেখতে হব।"
পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, "দ্রুত সময়ে উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয়ে সব ধরনের সংস্কার করা হবে এবং দ্রুত তা একনেকে উপস্থাপন করা হবে। সামাষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীলতা আনতে আমরা যে কৌশলে এগোচ্ছি, সেখানো প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানে পরিকল্পনা কমিশনের বিশাল দায়িত্ব আছে। পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে অর্থ বিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে, যাতে উন্নয়ন ব্যয়ের কারণে মূল্যস্ফীতি না বাড়ে। সৌভাগ্যের বিষয় হলো, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করার জন্য আমাদের ভালো একটা টিম আছে।"
এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, "জিডিপি প্রবৃদ্ধি কত বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন হার কত হলো— এগুলো অর্থনৈতিক মূল্যায়নের আসল মাপকাঠি নয়।"
"জিডিপি হিসাবে এমনিতেই সমস্যা আছে। জিডিপি বাড়লেই কি সব হয়ে গেলো? জিডিপির চেয়ে গুণগত মান বাড়ানো অনেক বেশি জরুরি। অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে অনেক বেশি ব্যয় করার চেয়ে, যেকুটু ব্যয় করা হয়, সেখানে সাশ্রায়ীভাবে হচ্ছে কিনা তা দেখতে হবে। সাশ্রায়ীভাবে এমন প্রকল্প বাস্তবায়নের কৌশল নিতে হবে, যার মাধ্যমে দ্রুত কিছু কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। আমাদের কাছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চেয়ে কর্মসংস্থান বাড়ানো অনেক জরুরি," যোগ করেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, "আগের সরকার অবকাঠামো প্রকল্প অনেক করতে চেয়েছিল, কারণে এতে উন্নয়ন দৃশ্যমান হয়। বড় বড় প্রকল্প যাছাই-বাছাই না করে নেওয়া হয়েছে। এ সময় অর্থায়নের দায়, বিদেশী ঋণের দায়ের কথা চিন্তা করা হয়নি। ঠিকাদার বা অন্যান্য গোষ্ঠীর স্বার্থে এসব প্রকল্পে কোনো সুপরিকল্পনা ছাড়াই নেওয়া হয়েছে। এবং এসব প্রকল্পের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার বিবেচনা করা হয়নি। কিছু কিছু প্রকল্প ভালো হয়েছে, কিন্তু অনেক বেশি প্রকল্পে বিশৃঙ্খলা রয়েছে।"
উদেষ্টা বলেন, "শুধু অবকাঠামো দিয়ে কোনো দেশ কখনো উন্নত হতে পারেনি। যদি মানব সম্পদ উন্নয়ন না হয়…..। মানব সম্পদ না থাকলে অবকাঠামো কঙ্কালের মতো মনে হয়। পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠোমোর সঙ্গে সঙ্গে মানব সম্পদের অনেক প্রকল্প আছে। মানব সম্পদের প্রকল্প শিক্ষা মন্ত্রণালের সঙ্গে জড়িত, কারিগরি প্রশিক্ষণের সঙ্গে জড়িত। পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা হিসাবে এটা আমার একটা বড় সুযোগ।"
বড় বড় প্রকল্পগুলো কেন এত বার সংশোধন করতে হলো, নকশা কেন সংশোধন করতে হলো? এসব প্রকল্পে নেওয়াই হয়েছিল কেন? কাদের স্বার্থে নেওয়া হয়েছিল। একটা প্রকল্প ৪ বার, ৫ বার কেন সংশোধন করে ব্যয় বাড়াতে হয়েছে— এ বিষয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) একটি প্রতিবেদন তৈরি করবে বলে জানান উপদেষ্টা। এই প্রতিবেদন তৈরির উদ্দেশ্য হবে যাতে ভবিষ্যতে ভুল না করা হয়।
তিনি বলেন, "পরিকল্পনা মন্ত্রণায়ের অধীনের একটি সংস্থা হলো বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো(বিবিএস)। এই প্রতিষ্ঠান ডিজিপি হিসাবসহ সামাজিক অর্থনৈতিক অনেক সূচকই প্রকাশ করে। এই প্রতিষ্ঠানের তথ্য সঠিক কিনা তা নিয়ে বহুদিন ধরে আলোচলা হয়ে আসছে বা তথ্য নিয়ে সন্দেহ আছে। এক্ষেত্রে কিছু ক্রটি হচ্ছে দক্ষতার অভাবে। আবার কিছু আছে ইচ্ছাকৃতভাবে। এসব বিষয়ে এখন থেকে জোর দেওয়া হবে।"
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "৫৫ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েরে মধ্যে ৪৫টির বেশিতে ঊর্ধ্বতনরা নিরুদ্দেশ। এসব বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা বড় চ্যালেঞ্জের। সারা দেশে উন্নয়ন প্রকল্প, প্রশাসনে বা শিক্ষা সব ক্ষেত্রে একই চিত্র।"