ফেনী-চট্টগ্রামে বন্যা: তলিয়ে গেছে বসতঘর, আশ্রয়হীন শত-শত মানুষ, হাজারো গাড়ি আটকা মহাসড়কে
ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের বাসিন্দা নাদিয়া জান্নাত। বন্যার পানিতে ঘর তলিয়ে যাওয়ায় প্রাণ বাঁচাতে পরিবারের নয় সদস্যসহ আশ্রয় নিয়েছেন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে মুহুরিগঞ্জ বাজারের নির্মাণাধীন রহমানিয়া শপিং সেন্টারের ভবনে।
তিনদিন বাড়ির পাশে এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নিলেও সেখানে পানি উঠে যায়। উপায় না পেয়ে শুক্রবার সকাল থেকে পরিবারটি ওই শপিং সেন্টারে অবস্থান করছে। ভবনটির উন্মুক্ত দুটি ফ্লোরে গাদাগাদি করে অবস্থান নিয়েছেন প্রায় দুই শতাধিক শিশু, নারী ও পুরুষ।
নাদিয়া জান্নাত বলেন, ঘরের কোনো জিনিস সরানো সম্ভব হয়নি। 'সব তলিয়ে গেছে পানিতে। যে হারে পানি বাড়ছে, কখন ফিরতে পারব জানিনা। এমন পরিস্থিতি জীবনেও দেখিনি।'
নাদিয়া জান্নাতদের মতো ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া, পরশুরাম, ফুলগাজী, সোনাগাজী এবং চট্টগ্রামের মিরসরাই ও ফটিকছড়ি উপজেলার বসিন্দাদের চিত্র একই। ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়ায় তারা আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি ও অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে।
তবে এসব এলাকা প্রায় পুরোপুরি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বেশিরভাগ ঘরবাড়িতে অবস্থান করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।
শুক্রবার (২৩ আগস্ট) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সড়কের দুপাশে পানির প্রবল স্রোত বইছে। মহাসড়কে হাজারো গাড়িতে আটকা পড়েছেন যাত্রীরা। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে স্বেচ্ছাসেবীরা ত্রাণ নিয়ে গেলেও সড়কে যান চলাচল বিঘ্নিত হওয়ায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে পারছেন না তারা।
ছোট ডিঙি নৌকায় পানিবন্দী পরিবারগুলোকে নিরাপদ আশ্রয়ে আনা গেলেও ভেতরের এলাকাগুলো থেকে লোকজনকে কোনোভাবেই আনা সম্ভব হচ্ছে না। গত তিনদিন ধরে এসব এলাকা পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। শুক্রবারও পানি কমার তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।
ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার নিজকনজুরা এলাকার ষাটোর্ধ্ব নারী বিবি মরিয়ম চারদিন নিজ ঘরে বন্দি থাকার পর স্বেচ্ছাসেবীরা উদ্ধার করে একটি আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। কিন্তু তার স্বামী গনি আহমদসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা এখনো ঘরে পানিবন্দী অবস্থায় আছেন।
তারা জীবিত আছেন কি না তার কোন খবর জানেন না মরিয়ম। পানির স্রোত তীব্র হওয়ার কারণে সেখানে উদ্ধারকর্মীরাও যেতে পারছেন না। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বসে পরিববারের সদস্যদের দুশ্চিন্তায় বিলাপ করে কাঁদছিলেন বিবি মরিয়ম।
নিজকনজুরা ও মুহুরীগঞ্জের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এমন বন্যা তাদের জীবনে আগে কখনো দেখেননি। যেভাবে ক্রমাগত পানি বাড়ছে পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কতটা ভয়াবহ রুপধারণ করে তা নিয়ে চরম আতঙ্কে আছেন তারা।
বন্যা কবলিত এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন। এক কাপড়ে অনেকে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। পুকুরের মাছ, গবাদিপশু, ঘরের আসবাবপত্র — কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। ক্ষেতের ফসল সব নষ্ট হয়ে গেছে। যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠা প্রায় অসম্ভব।
চট্টগ্রামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আলোর দিশারীর সংগঠক হোসাইন মাহমুদ বলেন, 'যে ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখছি, তা কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়বে। আমাদের সংগঠনের সদস্যরা সাঁতরিয়ে বিভিন্ন বাড়িতে আটকে পড়াদের উদ্ধার করছেন। এখনো অনেকেই পানিবন্দী অবস্থায় আছে।'
আটকে আছে হাজারো গাড়ি
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় সড়কে কয়েক হাজার গাড়ি আটকে আছে। চট্টগ্রাম বন্দর এবং বিভিন্ন স্থান থেকে পণ্য নিয়ে কাভার্ড ভ্যানগুলো বৃহস্পতিবার বিকেলে যাত্রা শুরু করলেও শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত ফেনীর নিজকনজুরা এলাকা পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছে।
কাভার্ড ভ্যান চালক মাসুদ রানা বলেন, 'চট্টগ্রাম থেকে পণ্য নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে বৃহস্পতিবার দুপুরে রওনা দিয়েছি। শুক্রবার দুপুর ২টা পর্যন্ত মুহুরীগঞ্জ এলাকায় যেতে পেরেছি।
'কোনো দোকানপাট খোলা না থাকায় চরম বিপাকে আছি। কখন ঢাকায় পৌঁছাতে পারব তার নিশ্চয়তা নেই।'
মিরসরাই থেকে ফাজিলপুর এলাকায় ত্রাণ দিতে যাওয়া শাফায়েত মেহেদী বলেন, যারা ত্রাণ দিচ্ছেন, তারা কেবল সড়কের পাশ্ববর্তী এলাকায় দিতে পারছেন। কোনো নৌকা না থাকায় ভেতরের এলাকায় যাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় প্রশাসনিকভাবে সমন্বয় করা গেলে দূরের এলাকাগুলোতেও ত্রাণ পৌছানো যেত।'
এদিকে যাত্রীবাহী বাসগুলোতে আটকে আছেন হাজার হাজার যাত্রী। চট্টগ্রামমুখী সড়কে যানজট কিছুটা কম থাকলেও ঢাকামুখী সড়কে তীব্র যানজট রয়েছে।