‘যতবার চোখ বন্ধ করি, আমার ভাইয়ের রক্তাক্ত চেহারা ভেসে ওঠে’
মাহমুদুর রহমান সৈকতের মাথায় যখন গুলি এসে লাগে, তখন তিনি বাড়ি থেকে কয়েক গজ দূরে নিজেদের পারিবারিক দোকানের কাছে ছিলেন।
তার মা আফরোজা রহমান, যিনি ইতোমধ্যেই তাকে খুঁজতে বিকেলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন, তিনি আসলে এই গুলির শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন।
ঘটনাস্থলেই সৈকতের মৃত্যু হয়।
তার বোন শাহরিনা আফরোজ সুপ্তি বলেন, "প্রত্যক্ষদর্শীরা আমাদের জানিয়েছেন, ঘটনাটি এতই আকস্মিক ছিল যে সে (সৈকত) বুঝতেও পারেনি কী ঘটেছে। দেখে মনে হয়েছিল, সে ঘুমিয়ে পড়েছে বা চেতনা হারাচ্ছে– যখন সে মাটিতে পড়ে যায়।"
"আমি তাড়াহুড়ো করে আমার নামাজ শেষ করলাম এবং বাড়ি থেকে ছুটে গেলাম। আমি খুব বেশি এগোতে পারলাম না; এত বিশৃঙ্খলতা ছিল, এত শব্দ এবং সবখানে টিয়ার শেল। তারপর আমি গুলির শব্দ শুনতে পেলাম। আমার মনে হয়েছিল, বুলেটটি আমার নিজের হৃদয়ে বিদ্ধ হয়েছে। আমি চিৎকার করে মেঝেতে পড়ে গেলাম।" কথাগুলো বলার সময় সুপ্তির গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল।
আমরা যখন মোহাম্মদপুরে সৈকতের বাড়িতে বসেছিলাম তখন তার শোকাহত পরিবারের সদস্যরা তাদের ছোট ছেলে এবং ভাইকে নিয়ে তাদের গল্প শোনাচ্ছিলেন, তার ছবি আমাদেরকে দেখাচ্ছিলেন। অথচ সৈকত আর বেঁচে নেই। তাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল, সৈকত আর বেঁচে নেই। এমনকি সৈকতের পোষা বিড়াল পুটুও ১৯ জুলাই থেকে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করছে না।
সৈকতের বাবা মাহবুবুর রহমান বলেন, "আমার ছেলের কোনো শত্রু ছিল না। সে খুবই ভদ্র এবং সবসময় হাস্যোজ্জ্বল ছিল। তার মৃত্যুর পর এলাকার সকল বাবা-মা এবং অভিভাবকরা আমার কাছে এসে আমাকে বলেছিল, আমি একজন অসাধারণ ছেলে পেয়েছি।"
'এসব খাবার আমার ছেলের রিজিকে ছিল না'
সৈকতের জন্ম ২০০৪ সালে। ফিরোজা বাশার আইডিয়াল কলেজে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর তিনি সরকারি মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পাস করেন। তিনি বেঁচে থাকলে আগামী ১১ সেপ্টেম্বর তার বয়স ২০ বছর হত।
সৈকত কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) নিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। সুপ্তি বলেন, "সে খুব আদরের ছিল, ছোট বেলায় দেখতে পুতুলের মতো ছিল। সে আমাদের ছোট ভাই ছিল। আমাদের কাছে সে সৈকত ছিল না, আমরা তাকে 'টুনা' বলে ডাকতাম। অন্য একজন চাচাতো ভাই তাকে 'দাসদাস' বলে ডাকত," বলেন সুপ্তি।
আমরা সুপ্তির ফোনের গ্যালারি থেকে সৈকতের ছবি দেখছিলাম। তার মা বলেন, "ওর উচ্চতা ছিল ৬ ফুট ২ ইঞ্চি, ব্যাচের সবচেয়ে লম্বা, এমনকি ওর শিক্ষকদের থেকেও লম্বা। সে কখনই খাবারের বিষয়ে অভিযোগ করেনি এবং টেবিলে যা দিতাম তাই খেত। কিন্তু সে আমার রান্না পছন্দ করত এবং সবসময় প্রশংসা করত।"
১৮ জুলাই থেকে সৈকত অস্থির হয়ে পড়েন। সারাদেশে ছাত্রদের হত্যার ভিডিও ও ছবি দেখতে থাকেন।
তার বোন বলেন, "বাড়ি থেকে বের হতে না দেওয়ায় একপর্যায়ে সে আমাদের ওপর সত্যিই রাগ করেছিল, খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। আমরা ওকে বোঝানোর চেষ্টা করে বলেছিলাম, বাইরে যাওয়া অনিরাপদ; ছাত্ররা শুধু আহত হচ্ছে না, ওদের গুলি করে মারা হচ্ছে। কিন্তু সে অনড় ছিল। ওদের জন্য কিছু করতে না পারার জন্য সে নিজেকে কাপুরুষ ভাবত।"
"ও আমাকে বলেছিল, সাহসী আবু সৈয়দ একাই পুলিশের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। ও ফারহান ফাইয়াজকে (ধানমন্ডিতে পুলিশের হাতে নিহত) চিনত। তার বন্ধুরাও আন্দোলনে অংশ নিচ্ছিল।"
সেই শুক্রবার সৈকত সকালে ঘুম থেকে উঠেন, নাস্তা সেরে নিজেদের দোকানে যান। তিনি প্রায়ই তার বাবার অনুপস্থিতিতে দোকানে বসে থাকতেন এবং সেদিন তার বাবা সন্দ্বীপে তাদের গ্রামে ছিলেন।
তারপর তিনি নিকটবর্তী বাজার থেকে বিড়ালের জন্য খাবার নিয়ে আসেন, গোসল করেন এবং জুমার নামাজ পড়তে যান। "প্রতি শুক্রবার রাতে আমার মেয়ে (সুপ্তি) তার স্বামীর সাথে রাতের খাবার খেতে আমাদের বাড়িতে আসে। আমরা সবাই একসাথে খাই, এটি একটি পারিবারিক ঐতিহ্য। সেদিন আমি গরুর মাংস এবং মুরগির মাংস রান্না করেছিলাম, ভেবেছিলাম একই রুটিন হবে। কিন্তু এসব খাবার আমার ছেলের রিজিকে ছিল না। সে আমার আগের দিন রান্না করা খাবার দিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরেছিল।"
দুপুরের খাবারের পর সৈকত দোকানে ফিরে যান। ততক্ষণে মোহাম্মদপুর একটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল কারণ পুলিশ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর একাধিকবার বর্বর হামলা চালায়।
তার মা তাকে দোকানে তালা দিয়ে বাড়িতে আসতে বলেন। এবং সৈকত কিছুক্ষণের জন্য বাড়িতে এসেছিলেনও। কিন্তু এটি মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য এবং কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে বেরিয়ে গেল। "ওর এক বন্ধুকে পুলিশ গুলি করেছিল এবং সে তাকে সাহায্য করতে দৌড়ে গিয়েছিল," সৈকতের মা বলেন।
তারপর ছেলেকে ফোন দিলেও সে না ধরায় তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন। একের পর এক ফোন করা হলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি। "আমরা সবসময় ভেবেছিলাম, আমাদের এলাকা অন্য এলাকার তুলনায় কিছুটা নিরাপদ। কিন্তু সেদিন এটি একটি রণক্ষেত্রের মতো ছিল।" চোখের পানি মোছার আগে সৈকতের মা আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলছিলেন।
'তাকে সন্দ্বীপে নিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না'
সৈকতের কয়েকটি ভিডিও দেখেছেন যেখানে কোনো একজন ব্যক্তি মাটিতে শুয়ে থাকা সৈকতের পকেট থেকে ফোন নিয়ে নিচ্ছে। তারা বিশ্বাস করেন, সেই ব্যক্তি সৈকতের বাবার ফোন পেয়ে তাকে জানিয়েছিলেন, তার ছেলে মারা গেছে।
সুপ্তি বলেন, "কেউ কীভাবে একজন মৃত ব্যক্তির কাছ থেকে ফোন চুরি করতে পারে?"
বিকেল ৩টা ৩৭ মিনিটে সৈকত গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সবাই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তাকে দ্রুত সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও ততক্ষণে তিনি মারা গেছেন।
সুপ্তি বলেন, "আমরা ছাত্রদের সমস্বরে চিৎকার করতে শুনেছিলাম, এটি একটি বিশাল আওয়াজ তৈরি করেছিল। কিন্তু আমরা জানতাম না, আমাদের ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে বলে তারা এভাবে চিৎকার করছিল। সে তার ফোন বের করতে যাচ্ছিল, ঘাড় কিছুটা বাঁকিয়েছিল এবং তখনই গুলিটি তার মাথায় বিদ্ধ হয়।"
তিনি বলতে থাকেন, "একজন পুলিশ অফিসার ওকে গুলি করেছিল। কিন্তু সেদিন যুবলীগের লোকেরাও উপস্থিত ছিল। তারা সবাই ছাত্রদের ওপর গুলি চালায়, বিশেষ করে সূর্যাস্তের পর।"
আফরোজা ভেবেছিলেন, হয়ত তার ছেলে মারাত্মক আহত হয়েছেন। "আমি বারবার লোকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, "বাঁচি আছে নি? পরান খান আছে নি? (সে কি বেঁচে আছে?) কিন্তু আমি জানতাম না, আমার ছেলেকে হত্যা করতে একটি মাত্র গুলি লেগেছে।"
খুবই কষ্ট নিয়ে সুপ্তি আমাদেরকে বলেন, "আমরা শুনেছি, ওর মগজ রাস্তার ধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছিল।"
মোহাম্মদপুরেই দাফন করা হয় ১৯ বছর বয়সী এই তরুণকে। তাকে সন্দ্বীপে নিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না।
'আমি আমার ছেলেকে সব জায়গায় খুঁজে বেড়াই'
বর্তমানে পরিবারের পক্ষ থেকে সৈকত হত্যাকাণ্ডের জন্য মামলা করার প্রস্তুতি চলছে। তবে তারা বলেছেন, এর আগে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কর্তৃপক্ষ তার মৃত্যু সনদে 'বন্দুকের গুলির আঘাত' থাকার বিষয়টি উল্লেখ করতে অস্বীকার করেছিল।
"তারা প্রথমে একটি রসিদে সেটি লিখলেও মৃত্যু সনদে মৃত্যুর কারণ লিখতে অস্বীকার করেছিল। মাত্র কয়েকদিন আগে সবন্তীর (সৈকতের অন্য বোন) কয়েকজন সিনিয়রের সহায়তায় আমরা মৃত্যু সনদ পেয়েছি। এতে মৃত্যুর আসল কারণ উল্লেখ করা হয়েছে," বলেন সুপ্তি।
তিনি বলতে থাকেন, "তারা বলেছিল, কিছু 'নিষেধাজ্ঞা' থাকার কারণে তারা 'বন্দুকের গুলি' শব্দটি উল্লেখ করতে পারেনি। শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও কেন এখনও বিধিনিষেধ রয়েছে? আমার ভাইকে যেখানে গোসল করানো [দাফন করার আগে] হয়েছে সেখানে তার মতো আরও অনেক যুবকের লাশ ছিল। তাদের সবাইকে ঠিক আমার ভাইয়ের মতো হত্যা করা হয়েছে।"
যে পুলিশ সদস্য সৈকতকে হত্যা করেছে, তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে সৈকতের পরিবার শুনেছে। কিন্তু এর বাইরে তারা আর কিছুই জানেন না। কিন্তু সবাই তাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছে। সবন্তীর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ জানিয়েছে, তারা কোনো টাকা ছাড়াই এই মামলা লড়বে।
বিলাপ করতে করতে সুপ্তি আমাদেরকে বলেন, "মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, হয়ত আমরা ওকে খুব বেশি শাসন করেছি। আমরা যদি ওকে আরও স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠতে দিতাম, তাহলে হয়ত সে বেঁচে থাকত? হয়ত সে কোনোভাবে বুলেট এড়িয়ে যেতে পারত?"
সুপ্তি জানিয়েছেন, তার এখন রাতে ঘুম হয় না। তিনি বলেন, "যতবার চোখ বন্ধ করি, আমার ভাইয়ের রক্তাক্ত চেহারা ভেসে ওঠে। যখন আমরা হাসপাতালে গিয়ে তার রিপোর্ট দেখেছিলাম এবং ইসিজি লাইনগুলো সব ফ্ল্যাট ছিল, পালস রেট ছিল শূন্য, আমার হৃদয় ভেঙে লাখ লাখ টুকরো হয়ে গিয়েছিল। আমাদের সবার মধ্যে সে ছিল সবচেয়ে নাদুসনুদুস, আমাদের সুন্দর বাচ্চা ছেলে।"
কয়েকদিন আগে একটি ফেসবুক পোস্ট ভাইরাল হয়েছিল। এতে বলা হয়, মোহাম্মদপুরের নুরজাহান রোডের স্টেপ জুতার দোকানের পাশের কোণায় প্রতিদিন একজন ব্যক্তিকে দেখা যায়। দেখে মনে হয়, তিনি কিছু খুঁজছেন; কিন্তু তার দৃষ্টি শূন্য। তাকে কেউ প্রশ্ন করলে তিনি কোনো উত্তর দেন না।
এটি ঠিক সেই জায়গা যেখানে সৈকতকে হত্যা করা হয়েছিল। আর ঐ ব্যক্তি সৈকতের বাবা মাহবুবুর রহমান।
কান্না করতে করতে মাহবুবুর রহমান আমাদের বলছিলেন, "আমি দিনে একাধিকবার সেখানে যাই। আমার দোকানে বা বাড়িতে থাকতে ভালো লাগে না। বিকেলে যখন এলাকার ছেলেমেয়েরা বাড়ির কাছে ক্রিকেট খেলে, আমি তাদের দলে আমার ছেলেকে খুঁজি। আমি আমার ছেলেকে সবখানে খুঁজে বেড়াই।"