ভারতীয় ভিসা আবেদন বন্ধ থাকায় শঙ্কায় ইউরোপগামী হাজারো শিক্ষার্থী, কর্মজীবী
গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর, সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে ভারতীয় ভিসা আবেদন। এতে বিপাকে পড়েছেন ইউরোপগামী প্রায় ১,৫০০ শিক্ষার্থী ও কর্মজীবী।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, বাংলাদেশে ইউরোপের অনেক দেশের দূতাবাস না থাকায় সেসব দেশের ভিসা ও অন্যান্য সেবার জন্য ভারতীয় দূতাবাসের ওপরে নির্ভর করতে হয়।
বর্তমানে ভারত ভিসা ইস্যু বন্ধ রাখায় তারা পড়াশোনা বা কাজের জন্য ইউরোপের ওইসব দেশে ভ্রমণ করতে পারছেন না। একইসঙ্গে, তাদের ভিসা ফি এবং টিউশন পেমেন্টের টাকা ফেরত পাওয়া নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এই শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই পূর্ব ইউরোপের দেশ পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, লিথুয়ানিয়া, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার লেটার পেয়েছেন।
ভালাহিয়া ইউনিভার্সিটি অফ তার্গোভিস্তে- তে সুযোগ পাওয়া তানজিম হাসান তুষার বলেন, "আমরা শুধু রোমানিয়ার ৮ শতাধিক শিক্ষার্থী অনলাইনে একটি ম্যাসেজিং গ্রুপে যুক্ত আছি, যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অফার লেটার পেয়ে ভিসার আবেদন করেছেন। এরমধ্যে ৩৫০ জনের মতো এক বছরের টিউশন ফি বাংলাদেশি অর্থে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা জমা দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টে। এখন ভিসার জন্য আবেদন করায় দিল্লির দূতাবাসে আমাদের ভাইভা আছে। সেটা ফেস না করলে ভিসা পাওয়া যাবেনা। ভিসা সেপ্টেম্বরের মধ্যে জমা দিতে না পারলে টিউশন ফি রিফান্ড হবে না।"
তুষার বলেন, "পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রায় দেড় হাজারের মতো শিক্ষার্থী জুন-জুলাই মাসে অফার লেটার পেয়েছে। অনেকেই জুলাইয়ের শেষে ভিসা আবেদন শুরু করে। আগস্টে দিল্লিতে ভাইভার ডেট হলেও ভারতের ডাবল এন্ট্রি ভিসা আবেদন অফ হয়ে যায়। এখন আমাদের উচ্চশিক্ষা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেলো।"
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে গত ৭ আগস্ট ভারতীয় ভিসা সেন্টারের ওয়েবসাইটে দেওয়া এক বার্তায় বলা হয়, পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় সব ভিসা সেন্টার বন্ধ থাকবে। পরবর্তী আবেদনের তারিখ এসএমএসের মাধ্যমে জানানো হবে।
পর্তুগাল যেতে ইচ্ছুক মো. ফরহাদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমি পর্তুগালে ফার্ম ওয়ার্কার হিসেবে ওয়ার্ক পারমিট পেয়েছি। আগামী ২৯ তারিখে দিল্লির পর্তুগাল দূতাবাসে আমার ভাইভা আছে। এখন ভারতের ডাবল এন্ট্রি ভিসা না পেলে পর্তুগালের রিফান্ডেফল ভিসা ফি ৩,৬০০ ইউরো ফেরত পাবো না।"
তিনি বলেন, "ভারতীয় হাইকমিশনে যোগযোগ করা হলে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যেতে বলা হয়। আমরা সেগুনবাগিচায় মন্ত্রণালয়ে গেলে তারা অপারগতা প্রকাশ করে।"
"বিগত ১০ দিন কুমিল্লা থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এসে ঘোরাফেরা করছি। কিন্তু কোনো সদুত্তর পাইনি। ইউরোপের দেশগুলোর দূতাবাস ঢাকায় থাকলে এ ধরনের ভোগান্তি পোহাতে হতোনা বাংলাদেশিদের," যোগ করেন তিনি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া অনুবিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, "আমরা গত দুই সপ্তাহ থেকে শিক্ষার্থী ও কর্মজীবীদের অভিযোগ পাচ্ছি। আমরা আমাদের দিক থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতির কারণে এর সুরাহা জটিল হয়ে পড়েছে।"
এদিকে, রোববার (২৫ আগস্ট) দুপুরে সেগুনবাগিচায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ভিসা সংকট সমাধানের দাবিতে মানববন্ধন করেন একদল শিক্ষার্থী ও কর্মজীবী মানুষ। সেখানে কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, পাসপোর্ট ডেলিভারির পরে অনেকে আবার রিজেক্ট হচ্ছে। যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশে ভারতীয় ভিসা আবেদন পুরোপুরিভাবে চালুর অনুরোধ করছি। পাশাপাশি কোনো আবেদনকারীর বিনা কারণে ভিসা রিজেক্ট না করার আহ্বান থাকলো। রিজেক্ট করলে যেন যথেষ্ট কারণ উল্লেখ করে দেওয়া হয়।
চেক রিপাবলিকে সুযোগ পাওয়া মাইন উদ্দিন বলেন, "পোল্যান্ড, পর্তুগাল, বুলগেরিয়া, চেক রিপাবলিক, রোমানিয়া, লিথুয়ানিয়া, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের দূতাবাস বাংলাদেশে নেই। এসব দেশে পড়তে হলে ভারতে ভিসা সাক্ষাৎকার দিতে হয়। কিন্তু ভারতের ভিসা না থাকায় তারা নির্দিষ্ট দেশের অ্যাম্বাসিতে সাক্ষাৎকার দিতে পারছেন না। তাই বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিল হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।"
তিনি অভিযোগ করেন, "টিউশন ফি জমা দেওয়ার পরও বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ভারতের কারণে।"
"সেপ্টেম্বরের ১৫ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে অ্যাম্বাসি সাক্ষাৎকার দিতে না পারলে তাদের ভর্তি বাতিল হয়ে যেতে পারে। একইসঙ্গে টিউশন ফি বাবদ জমা দেওয়া অর্থ ফেরত না পাওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়। কারণ, অ্যাম্বাসি থেকে ভিসা না পাওয়ার কারণ উল্লিখিত পত্র জমা না দেওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টিউশন ফি ফেরত না-ও দিতে পারে। পরবর্তী সময়ে ফেরত দিলেও বেশির ভাগ সময় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ টাকা কেটে রাখে," যোগ করেন তিনি।
এদিকে, ভারতে চিকিৎসার জন্য যাওয়া বাংলাদেশি রোগীরাও গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। ভিসা না পাওয়ায় পরবর্তী চিকিৎসার জন্য অনেকেই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ডাক্তার দেখাতে ভারতে যেতে পারছেন না।
এরকম এক রোগী নাজনীন আক্তার (৩৩) বলেন, "কলকাতার একটি হাসপাতালে আইভিএফ (ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন) চিকিৎসা করাতে এর আগে তিন মাস ভারতে ছিলাম। ৫ সেপ্টেম্বর আমার শিডিউল আছে। আমার মেডিকেল ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ায় বিপদে পড়েছি। এখন আবেদন বন্ধ থাকায় ৫ তারিখের অপারেশন নিয়ে শঙ্কায় আছি। সেটি সময়মতো করাতে না পারলে আমার স্বাস্থ্য চরম ঝুঁকিতে পড়বে বলে জানিয়েছেন ডাক্তাররা।"
তাবজিনা আজিজ নামের আরেক ভিসা প্রার্থী বলেন, "আমাকে আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে পেটের টিউমার চিকিৎসার ফলো আপ করাতে চেন্নাই যেতে হবে। এখন ভীষণ বিপদে পড়েছি ভিসার মেয়াদ না থাকায়। দ্রুত ভিসা না পেলে আমার জীবন শঙ্কার মধ্যে পড়বে।"