ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের আশ্বাসেও শান্ত হয়নি আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল, ১৭ কারখানায় ছুটি ঘোষণা
শিল্প মালিকসহ বিভিন্ন অংশীজনদের সাথে ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের বৈঠকে তাদের আশ্বাস সত্ত্বেও স্বাভাবিক হয়নি আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের পরিস্থিতি। আজ শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর) আশুলিয়ায় অন্তত ১৭টি পোশাক কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
দিন শেষে ছুটি ঘোষণা করা এই পোশাক কারখানার সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে শিল্প পুলিশের একাধিক সূত্র।
গত কদিনে আশুলিয়ার তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে যে অস্থিরতার ঘটনা ঘটেছে, তা নিয়ে গতকাল (৬ সেপ্টেম্বর) শিল্প মালিক, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নের নেতাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে দুই দফা বৈঠকের পর বিজিএমইএ নেতারা আজ থেকে সকল পোশাক কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সকাল থেকে শ্রমিকদের বিক্ষোভের মুখে আবারও অশান্ত হয়ে ওঠে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল।
তবে পরিস্থিতি গত কয়েকদিনের তুলনায় অনেকটাই ভালো দাবি করে শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার আলম টিবিএসকে বলেন, "শ্রমিকরা কাজ না করায় এবং কিছু কারখানার ম্যানেজমেন্ট না আসায় আজ ১৭টির মত কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।"
তিনি বলেন, "একটা কারখানার শ্রমিকরা বের হয়ে গেলে সেই শ্রমিকরা চেষ্টা করেন, অন্যান্য কারখানায় তাদের পরিচিতদের বের করে আনার। যার কারনে সমস্যা না থাকলেও অনেক কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের কারখানার শ্রমিকদের ছুটি দিয়ে দেয়।"
মালিকপক্ষ ও শ্রমিকদের সাথে আলোচনা করে সমস্যা নিরসনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার আলম।
এদিকে আজ সকালে শিল্প পুলিশের একাধিক সূত্র দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছে, সকালে শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ার অধিকাংশ কারখানা খুলে দেওয়া হলেও আশুলিয়ার বাইপাইল-আব্দুল্লাহপুর সড়কের নরসিংহপুর এলাকায় কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা কারখানায় কাজ না করে বেরিয়ে গেলে পরিস্থিতি আবারও ঘোলাটে হয়ে ওঠে। গত কয়েকদিন ধরে বিশেষ করে এই অঞ্চলটিতেই অস্থিরতা চলমান রয়েছে।
তবে এখন পর্যন্ত কোনো কারখানায় হামলা, ভাঙচুর কিংবা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সংবাদ পাওয়া যায়নি। শ্রমিকরা বিক্ষোভ করার পাশাপাশি কাজ না করে যার যার মত কারখানা থেকে বেরিয়ে বাসায় ফিরে যাচ্ছেন।
শিল্প পুলিশ, সেনাবাহিনীর ও বিজিবি সদস্যরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন।
বিজিএমইএ সূত্র জানায়, আশুলিয়ায় হামীম গ্রুপের কার্যক্রম চলমান থাকলেও বন্ধ রয়েছে নিউ এইজ-এর কার্যক্রম। নাসা গ্রুপের শ্রমিকরা কারখানায় এলেও পরবর্তীতে বেরিয়ে যান। অনন্তর শ্রমিকরা কারখানার ভিতরে আছেন, তবে কাজ করছেন না। আল-মুসলিমেরও একই অবস্থা।
এর বাইরে এনভয়, উইন্ডি, রোজ, মেডলার, পলমল, এফএনএফ, ব্যান্ডো, স্টারলিং কারখানাগুলো চালু আছে। এছাড়া জিরাবো থেকে বিশমাইল পর্যন্ত সড়কের কারখানাগুলোতেও কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
বিটপী গ্রুপের জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক এবিএম সিরাজুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "আশুলিয়া জোনের অবস্থা অনেকটা আগের মতোই রয়েছে। অনেকগুলো কারখানার শ্রমিকরা আসলেও তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে শারমিনের শ্রমিকদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন,"নাসা, অনন্ত আগের থেকে বন্ধ থাকলেও তাদের শ্রমিকরা আসছেন এবং এসে বিক্ষোভ করছেন। ক্রিয়েশন চালু থাকলেও সেটা বন্ধ করে দিতে হতে পারে কারণ সেটি একই এলাকাতে আছে।"
এদিকে তৃণমূলের শ্রমিক নেতারা মনে করছেন, বিজিএমইএসহ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে অংশীজনদের সাথে দফায় দফায় যেই আলোচনা হয়েছে তাতে তৃণমূলের শ্রমিক নেতাদের অংশগ্রহণ কম; যেটি সমস্যা সমাধান না হওয়ার একটি অন্যতম কারণ। চলমান শ্রমিক অসন্তোষে শ্রমিক নেতাদের নিয়ন্ত্রণ কম বলেও দাবি করেন তারা।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু টিবিএসকে বলেন, "বিজিএমইএ বা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যেই আলোচনা করা হচ্ছে তাতে মাঠ পর্যায়ের কিংবা তৃণমূলের শ্রমিক নেতাদের অংশগ্রহণ খুবই কম। পরিস্থিতির উন্নতির জন্য তাদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি কারণ আঞ্চলিক নেতারা সরাসরি শ্রমিকদের সঠিক বার্তাটি পৌঁছে দিতে বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।"
তবে তিনি স্বীকার করেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর চলমান শ্রমিক আন্দোলনে শ্রমিক নেতাদের ভূমিকা খুবই কম। অনেক ক্ষেত্রেই শ্রমিকরা বলছেন, তাদের কোন ট্রেড ইউনিয়ন লিডারের প্রয়োজন নেই।
তাই চলমান সমস্যা সমাধানে তৃণমূলের শ্রমিক নেতাদের অংশগ্রহণের গুরুত্ব তুলে ধরেন খায়রুল মামুন মিন্টু।
উল্লেখ্য, আশুলিয়ায় পোশাক কারখানায় নারী-পুরুষের সমানুপাতিক হারে নিয়োগসহ বিভিন্ন দাবিতে নবীনগর-চন্দ্রা ও বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়ক অবরোধ করে সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) বিক্ষোভ করেন চাকরিপ্রত্যাশী শ্রমিকরা। একপর্যায়ে আন্দোলনরত শ্রমিকরা নবীনগর-চন্দ্রা ও বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে ব্যারিকেড তৈরি করে অবরোধ করেন ও বিভিন্ন কারখানা লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করেন।
এমন পরিস্থিতিতে বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়কের বাইপাইল থেকে জিরাবো পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে অবস্থিত অন্তত ৩০টি কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের কারখানায় ছুটি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
পরবর্তীতে সেদিন সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে যৌথ অভিযান পরিচালনার কথা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম।
বৈঠকে বিশৃঙ্খলায় জড়িত বহিরাগতদের আইনের আওতায় আনার নির্দেশনা দিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পুলিশ, শিল্প পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন। এছাড়া অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) থেকে সব কারখানা চালু রাখতে মালিকদের অনুরোধ জানান তিনি।