রাখাইনে সংঘাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে ১৫,০০০ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ
কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যাংছড়ির সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে গত ৮-১০ দিনে ১৫ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র। বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে তারা।
এছাড়া, বাংলাদেশ অনুপ্রবেশের জন্য আরও ৫০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা সীমান্তবর্তী এলাকায় অপেক্ষায় আছে বলে জানা গেছে।
নাফ নদী দিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশের সীমান্তে প্রবেশ করাতে কাজ করছে দালাল চক্র।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেসরকারি আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন অ্যান্ড দ্য অফিস অফ দ্য রিফিউজি রিলিফ অ্যান্ড রিপ্যাট্রিয়েশন- এর দুটি সূত্র সাম্প্রতিক দিনগুলোতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
নতুন প্রবেশকারীদের মধ্যে আহত শিশু ও নারীরা রয়েছেন। অনানুষ্ঠানিকভাবে তারা চিকিৎসা সহায়তাও পাচ্ছেন বলে জানিয়েছে সূত্র।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর ও সীমান্ত এলাকার স্থানীয়দের তথ্যমতে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমার সরকার ও দেশটির রাইখাইন রাজ্যের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে ফের সংঘাত শুরু হয়। সীমান্তবর্তী এলাকা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর দখলে আসে। আরাকান আর্মির প্রতিরোধের মুখে জীবন বাঁচাতে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনাও ঘটে। এরপর থেকে সংঘাত অব্যাহত রয়েছে।
স্থানীয়দের তথ্যমতে, কক্সবাজার ও বান্দরবানের সীমান্তবর্তী এলাকগুলোতে ২৫-৩০টি পয়েন্ট দিয়ে দালাল চক্রের মাধ্যমে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে। এরমধ্যে রয়েছে— টেকনাফ সীমান্তের জাদিমোরা, দমদমিয়া, কেরুনতলি, বরইতলি, নাইট্যংপাড়া, জালিয়াপাড়া, নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, নয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপ, জালিয়াপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া, ঘোলারচর, খুরেরমুখ, আলীর ডেইল, মহেষখালীয়াপাড়া, লম্বরী, তুলাতলি, রাজারছড়া, বাহারছড়া; উখিয়ার রহমতের বিল, আনঞ্জুমানপাড়া, বালুখালী, ধামনখালী; নাইক্ষ্যাংছড়ির ঘুমধুম, পশ্চিমপাড়া, বাইশফাড়ি, তমব্রু, আমতলী সীমান্ত।
গত রোববার রাতে নাফ নদী পেরিয়ে টেকনাফের কেরনতলির এক বাসিন্দার বাড়িতে আশ্রয় নেন ১৫ শিশু ও ৯ নারীসহ চারটি পরিবারের ৩০ জন রোহিঙ্গা। তাদের বাড়ি মংডু টাউনশিপের পাশের গ্রাম সুদাপাড়াতে।
আশ্রয় নেওয়া দলটির মধ্যে দুজন হলেন জাহেদা বেগম (৩৫) ও নুর জাহান (৪০)।
তারা টিবিএসকে বলেন, "সাত-আট দিন ধরে মংডুতে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধে উভয় পক্ষ শক্তিশালী গ্রেনেড-বোমা, মর্টার শেলের পাশাপাশি ড্রোন হামলা চালাচ্ছে। যুদ্ধবিমান থেকেও বোমা নিক্ষেপ করা হচ্ছে। তাতে অনেক মানুষ হতাহত হচ্ছেন। যুদ্ধের মধ্যে অনেক রোহিঙ্গা বসতি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে তাই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টায় রয়েছেন। তবে নৌকার অভাবে বাংলাদেশে ঢুকতে সমস্যা হচ্ছে।"
টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের যে পরিমাণ সংখ্যা প্রচার হচ্ছে, তা ঠিক নয়। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু অনুপ্রবেশ ঘটছে। আমরা সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করছি। গত একমাসে প্রায় ৪,৫০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। নাফ নদীতে টহল জোরদার করা হয়েছে।"
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোর সিদ্ধান্ত রয়েছে। কারণ বিদেশি সাহায্য কমেছে। প্রতিদিন নতুন নতুন শিশু জন্ম নিচ্ছে। জনসংখ্যার চাপ এমনি বাড়ছে।"
"যারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আসছেন, তারা বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে থাকা তাদের আত্মীয়স্বজনদের কাছে আশ্রয় নিচ্ছেন। আমাদের কাছেও কোনো হিসাব নেই, কী পরিমাণ অনুপ্রবেশ ঘটেছে," যোগ করেন তিনি।
টেকনাফ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ গভীর রাতে ঘটছে বেশি। সবগুলো পয়েন্ট নজরদারি করা যাচ্ছে না। সক্ষমতা বাড়াতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।"
স্থানীয় একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, দালাল চক্রগুলো মাধ্যমেই বেশকিছু সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে রোহিঙ্গারা।
টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর আরাফা বেগম বলেন, "মিয়ানমারের রাখাইনের ওপারে মর্টার শেল ও শক্তিশালী গ্রেনেড-বোমার বিস্ফোরণে এপারের ঘরবাড়ি কাঁপছে। বিস্ফোরণের শব্দ শুনে মনে হয় বসতঘরের চালার ওপর বোমা এসে পড়ছে।"
"রাতে বিকট শব্দের বিস্ফোরণে ঘুম ভেঙে শিশুরা কান্নাকাটি শুরু করে দিচ্ছে," যোগ করেন তিনি।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের নিয়ে ইতিহাস বিষয়ক বই 'আ হিস্টোরি অফ রোহিঙ্গাস টু ১৯৪৮' এর লেখক আমান উল্লাহ আরাকানের চলমান যুদ্ধ নিয়ে খোঁজখবর রাখছেন।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "শুরুতে রোহিঙ্গাদের অবস্থান ছিল মিয়ানমার জান্তা বাহিনী বা বার্মা আর্মির বিপক্ষে। কিন্তু আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা চালানো শুরু করে। অপরদিকে প্রায় দুই হাজার রোহিঙ্গা বার্মা আর্মির প্রশিক্ষণে যায়। সবমিলে রোহিঙ্গারা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে আছে।"
তিনি বলেন, "বার্মা আর্মি বিমানে হামলা চালালে রোহিঙ্গারা আহত হচ্ছেন। আবার আরাকান আর্মির নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। প্রায় ৫ লাখের কাছাকাছি রোহিঙ্গার মধ্যে কিছু বাংলাদেশে নিরাপদে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছেন। আর কিছু মংডুসহ শহরের নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছেন। বেশিরভাগ বাসা-বাড়িতে থাকতে পারছেন না দুপক্ষের হামলার কারণে। সেখানে খাবারের ও টাকা-পয়সার সংকট দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত বাহিনী, প্রভাবশালী ও দালালরা অর্থে বিনিময়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের প্রবেশ করাচ্ছেন।"