ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি বন্ধচেষ্টার নিন্দা গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার চেষ্টার নিন্দা জানিয়েছে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি।
গত ২২ আগস্ট শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী, আইনজীবী, চিকিৎসকসহ সমাজের নানা পেশার মানুষের সমন্বয়ে শতাধিক ব্যক্তি নিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়। এরপর গতকাল শুক্রবার বিকেল ৪টায় প্রথম এই সমাবেশ করে সংগঠনটি।
সমাবেশে বক্তারা– জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমানো, সীমান্ত হত্যা, মাজার-মন্দিরসহ ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু এবং নারীর উপর আক্রমণ ও বিচারবহির্ভুত হত্যাকান্ড বন্ধ করে জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ-শ্রেণি বৈষম্যহীন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ বিনির্মাণের দাবি জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা নিত্রার সঞ্চালনায়, এই সমাবেশে সভাপ্রধানের ভূমিকা পালন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ।
শিক্ষার্থী, সংস্কৃতিকর্মী, মানবাধিকারকর্মী, শ্রমিক, হরিজন, রাজনৈতিক কর্মী, গবেষক, শিল্পী, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের উপস্থিতিতে এতে আরো বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, চিকিৎসক ডা. হারুন-অর-রশীদ, পাহাড়ের রাজনৈতিক কর্মী আয়নাঘর থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত মাইকেল চাকমা, গবেষক মাহা মির্জা, গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটের সমন্বয়ক সালমান সিদ্দিকী, রিকশা শ্রমিক আবদুল কুদ্দুস, গার্মেন্টস শ্রমিক শাজাহান, মিরনজিল্লার হরিজন নারী নেত্রী পূজা রানী দাশ, চট্টগ্রাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার অধিকার রক্ষা পরিষদের পক্ষ থেকে আসমা আক্তার এবং আহত শিক্ষার্থী ফজলে রাব্বি।
সভায় সভাপতিত্ব ও সমাপনী বক্তব্য প্রদান করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
তিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ, নিখোঁজ ও আহতদের তালিকা প্রকাশ এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ; জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণ; 'পাহাড় থেকে সেনাশাসন প্রত্যাহার'; বম আদিবাসীদের মুক্তি দেওয়া; সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করা; রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টাদের চিকিৎসা বাধ্যতামূলকভাবে দেশে করা; বিদেশি ঋণনির্ভর, আমদানিনির্ভর, বিদেশি কোম্পানি-নির্ভর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মহাপরিকল্পনা বাতিল করাসহ বিভিন্ন দাবি জানান।
সমাবেশে তার বক্তব্যে অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, 'ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের ৪৫ দিন হলো– কিন্ত দেশে কয়টি সরকার চলছে তা স্পষ্ট না। ওদিকে মাজার, মন্দিরসহ বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনায় হামলা হচ্ছে। এটি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য ছিল না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ৪৫ দিন পেরিয়ে গেলেও– কোন সংস্কারের রোডম্যাপ ঘোষণা করেনি। একটি দেশের উন্নয়নের মাপকাঠি হতে হবে তার শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি কত, তা দিয়ে। সবার জন্য সমান সুযোগ না থাকলে যে গণতন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে তা মেকি হবে। আমাদের এই মুহুর্তের প্রধান কাজ পঙ্গু অর্থনীতিকে সচল করা। সেটি না হলে এই সরকারও থাকবে না।'
চিকিৎসক হারুন উর রশীদ বলেন, ১৯৭২ থেকে আজ অবধি আমরা দেখেছি ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত যে ছাত্র সংগঠন থাকে তারা আধিপত্য বিস্তার করে, সম্প্রতি টিএসসি থেকে দোকান উঠিয়ে দেওয়া, কিংবা ঢাবিতে একজন মানুষকে অত্যাচার করে মেরে ফেলার মধ্য দিয়ে আমরা এই ক্ষমতার দম্ভ দেখছি।'
পাহাড়ের রাজনৈতিক কর্মী এবং আয়নাঘরে দীর্ঘ ৫ বছর বন্দি থাকার পর মুক্তিপ্রাপ্ত মাইকেল চাকমা বলেন, 'খাগড়াছড়ি দীঘিনালায় অগ্নিসংযোগ কোন নতুন ঘটনা না। … একটা দেশে দুই শাসনব্যবস্থা চলছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রালয়ের ১১ দফা জারি আছে, যেখানে পাহাড়ের মানুষ সমতল থেকে বিচ্ছিন্ন। অথচ আমরা যখন পাহাড়ের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বলি আমাদেরকে সন্ত্রাসী বলা হয়।'
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, 'আইন হতে হবে জনগণের প্রয়োজনে। পুলিশ বাহিনীকে রাষ্ট্রযন্ত্র সরকারের লেজুড় বাহিনী পরিণত করে তার সমস্ত মোরাল গ্রাউন্ড নষ্ট করে দিয়েছে। সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে পুলিশের কাজ হতে পারে না। আইনশৃঙ্খলাকে যদি অগ্রাধিকার না দিই, তবে নিয়মকে ডিঙ্গিয়ে জোর জবরদস্তি প্রাধান্য পাবে এবং মাজার, মন্দির, সংখ্যালঘুর ওপর হামলার মাধ্যমে আমরা সেই জোরজবরদস্তিই দেখতে পাচ্ছি'।
মিরনজিল্লা সিটি কলোনির নারী নেত্রী পূজা রানী দাশ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে হরিজনদের ভূমির মালিকানার দাবি জানান।
গার্মেন্টস শ্রমিক শাজাহান বলেন যে, শ্রমিক কলোনির নামে খাস জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল শেখ হাসিনার আমলে, কিন্ত একটা ইটও সেখানে স্থাপিত হয়নি। শ্রমিকদের ন্যুনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকার পাশাপাশি বাসস্থান এবং রেশনের দাবি জানান তিনি।
গবেষক মাহা মির্জা উল্লেখ করেন যে, গার্মেন্টস শ্রমিক যখন আন্দোলন করছে, তখন শ্রম উপদেষ্টা বলছেন যে শ্রমিকদেরকে উস্কানি দিয়ে আন্দোলন করানো হচ্ছে। যা শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারের শ্রমিক আন্দোলন বন্ধ করার পাঁয়তারাকেই প্রতিধ্বনিত করে। ২০২২ সালে দুদকের গবেষণায় দেখা গিয়েছে বাংলাদেশের গার্মেন্টস মালিকরা প্রতিবছর ৩৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে। পাচার করেও কিন্তু তারা রাষ্ট্রের সমস্ত ব্যাংকিং ঋণ, ভর্তুকি ও প্রণোদনা সুবিধা পায়। সেই মালিকের সাথে সুসম্পর্ক রেখে ব্যবসায়ীদের ভাষায় কথা বলে শ্রমিকদের আন্দোলন বন্ধ করতে যৌথ অভিযানের উদ্যোগ কোন বৈষম্যবিরোধী রাষ্ট্র তৈরির প্রক্রিয়া হতে পারে না।
গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের সমন্বয়ক সালমান সিদ্দিকী জানান যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার নামে মত প্রকাশ ও সমাবেশ করার অধিকার কেড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তটি অগন্তান্ত্রিক। তিনি এই সিদ্ধান্ত বাতিলের আহবান জানান।
সভা শেষে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির পক্ষ থেকে পাহাড়ে সেনাশাসন প্রত্যাহারের দাবিতে এবং ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার প্রতিবাদে একটি মিছিল শহীদ মিনার থেকে রাজু ভাস্কর্যে গিয়ে শেষ হয়।