শহিদ আফনানের মা, দিন কাটছে তার হাহাকার আর আর্তনাদে
প্রাইভেট পড়তে গিয়েছিলেন সাদ আল আফনান। সেখান থেকে আন্দোলনে। বাড়ি আর ফেরা হয়নি তার।
প্রাইভেট পড়া শেষ করে আফনান (২২) বন্ধুদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে যুবলীগ হামলা শুরু করে। গুলি চালানো হয় শিক্ষার্থীদের ওপর।
এক সহপাঠীকে বাঁচাতে গিয়ে আফনান গুলিবিদ্ধ হন। সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়েন লক্ষ্মীপুর শহরের মাদাম ব্রীজের ওপর। এরপর আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি আফনান। সবার চোখের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে না ফেরার দেশে চলে যান তিনি। এমন মৃত্যুতে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন তার সহপাঠী ও তৎকালীন আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা।
মানতে পারছেন না আফনানের মা নাছিমা আক্তারও। স্বামীকে হারানোর পরপরই হারালেন ছেলেকেও। তার এখন দিন কাটে হাহাকার আর আর্তনাদে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও শিক্ষার্থীরা জানান, ২০২৪ সালের ৪ আগষ্ট। বেলা ১১টা। সারাদেশের মতো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে উত্তাল ছিল পুরো লক্ষ্মীপুর। মিছিলে মিছিলে মুখরিত ছিল পুরো শহর। আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা উত্তর তেমুহানী থেকে একটি মিছিল নিয়ে ঝুমুর চত্ত্বরের দিকে যাচ্ছিল। মিছিল থেকে তারা আকস্মিক হামলা চালানো শুরু করে। পাল্টা প্রতিরোধের চেষ্টা করে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীরা। এ সময় জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদের অপসারণকৃত চেয়ারম্যান একেএম সালাউদ্দিন টিপুর নেতৃত্বে মুহুর্মুহু গুলি ছোড়ে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে ব্রিজের ওপর গুলিবিদ্ধ হন আফনান। হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান তিনি।
এর জের ধরে ফুঁসে ওঠে শিক্ষার্থীরা। মিছিল নিয়ে বাজারের দিকে এগোতে থাকে তারা। শহরের তমিজ মার্কেট এলাকায় পৌঁছালে নিজ বাসভবনের ছাদ থেকে প্রকাশ্যেই সালাউদ্দিন টিপু ও তার সহযোগিরা শিক্ষার্থীদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে এইচএসসি পরীক্ষার্থী কাউছার উদ্দিন বিজয় ও তৌহিদ কবির রাফি এবং সাব্বির হোসেনসহ আরো তিনজন মারা যায়। এ সময় তিন শতাধিক গুলিবিদ্ধসহ আহত হয় কমপক্ষে ৫০০-র বেশি শিক্ষার্থী।
এ ঘটনায় পৃথক তিনটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। টিপু ও জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহিন আলমের শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়।
শহিদ আফনান লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বাস টার্মিনাল এলাকার সালেহ আহম্মদ ও নাছিমা আক্তার এর ছেলে। লক্ষ্মীপুর ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন তিনি।
সাদ আল আফনান হত্যায় অপসারণ করা লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি একেএম সালাহ উদ্দিন টিপুকে প্রধান করে ৭৫ জনের নাম উল্লেখ করে ও আরো ৭০০জনকে অজ্ঞাত আসামি করে আফনানের মা নাছিমা আক্তার বাদী হয়ে সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এতে আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের পধদারী নেতাদের নামও রয়েছে। এরপর আসামিরা আত্মগোপনে থেকে মামলার বাদী ও স্বজনদের বিভিন্ন ভয়ভীতি ও হত্যার হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছে। এতে ভয়ে বাসায় তালা দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আফনানের বিধবা মা নাছিমা আক্তার। জড়িতদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান নিহতের স্বজন ও সহপাঠিরা।
আফনানের মা মামলার বাদী নাছিমা আক্তার বলেন, ঘটনার তিন মাস আগে স্বামী সালেহ আহমদ বিদেশে মারা যান। সেই শোক সইতে না সইতে একমাত্র ছেলেকে হারালাম। এখন আর আমার কেউ রইল না। সালাউদ্দিন টিপুর নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা আমার মেধাবী ছেলেকে গুলি করে হত্যা করেছে। এখন মামলা করেও ভয়ে আছি। আফনানের কথা ভুলতে পারি না। কী দোষ ছিল তার। কী অপরাধ ছিল?
এদিকে লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব শহীদ উদ্দিন এ্যানী বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সন্ত্রাসী একেএম সালাউদ্দিন টিপুর নেতৃত্বে যেভাবে অবৈধ অস্ত্র দিয়ে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালিয়ে চার শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়েছে, অসংখ্য শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়েছে, এটি কোনো সভ্য দেশে হতে পারে না। হত্যাকারীদের বিচার হবেই হবে। কোনোভাবেই তাদের ছাড় দেওয়া হবে না।
এছাড়া জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি ফারুক হোসাইন নুরনবী বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে প্রকাশ্যে যুবলীগ নেতা সালাউদ্দিন টিপুর নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা যেভাবে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়েছে, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার নির্দেশে পাখির মতো ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করা হয়েছে, তা ভাবা যায় না।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ইয়াছিন ফারুক মজুমদার বলেন, যারা শিক্ষার্থীদের গুলি করে হত্যা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। বাকি আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।