কর্মকর্তাদের বদলির আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে উপদেষ্টাদের সম্মতি নেওয়ার নির্দেশ
কয়েকজন উপদেষ্টা তাদের আওতাধীন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বদলি বা পদায়নের আগে সম্মতি নেওয়ার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি এক চিঠিতে উপদেষ্টারা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন— হুট করে কর্মকর্তাদের বদলি করায় কাজ করতে সমস্যায় পড়ছেন তারা। অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের বদলি করে নতুন যাদের দেওয়া হচ্ছে, তাদের বেশিরভাগই দায়িত্বপ্রাপ্ত পদের কার্যক্রম সম্পর্কে আগে থেকে অবহিত নন। এর ফলে কার্যক্রমে গতি আসছে না।
জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানালেও, ওই চিঠির একটি অনুলিপি পেয়েছে টিবিএস।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে চিঠিটি দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে সেই চিঠির বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
একইভাবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এবং আরও একজন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এ ধরনের চিঠি পাঠিয়েছেন বলে জানা গেছে। এই চারজন উপদেষ্টার অধীনে ১০টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব রয়েছে।
এ বিষয়ে উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ সোমবার বিকালে তার ভূমি মন্ত্রণালয়ের দপ্তরে বসে টিবিএসকে বলেন, "বিষয়টি পুরোপুরি ঠিক না যে, কোনো বিধিবিধান করে বদলী বা পদোন্নতির জন্য বলা হয়েছে। তবে এটা ঠিক যে, উপদেষ্টা পরিষদে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।"
তিনি বলেন, "হঠাৎ করে পরিবর্তন ঠিক হচ্ছে না। যেসব গুরুত্বপূর্ণ পদ বা দপ্তর রয়েছে, সেখানে পরিবর্তনের আগে যাতে আলোচনা করা হয়, সেটি বলা হয়েছে।"
যদিও চিঠি দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেননি তিনি।
প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এ ধরনের কোনো সম্মতি নেওয়ার নির্দেশনা দেননি বলে জানিয়েছেন।
আর গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান একমাস পরে এ বিষয়ে কথা বলবেন বলে জানিয়েছেন।
সাবেক সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে যাওয়ার পরপরই সিভিল প্রশাসন অনেকটা ভেঙ্গে পড়ে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রশাসনের কর্মকর্তারা অফিস করা শুরু করলেও কার্যক্রম এখনো পর্যন্ত পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি।
জনপ্রশাসনে একটি শ্রেণি তৈরি হয়েছে, যারা গত ১৫ বছর যাবৎ বঞ্চিত হয়েছেন— এমন দাবি করে পদোন্নতি ও ভালো পদে পদায়নের জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন।
সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এ নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সামনে কর্মকর্তারা জোটবদ্ধ হয়ে অবস্থানও নেন। ১০ ও ১১ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ নিয়ে সচিবালয়ে হট্টগোলের ঘটনাও ঘটে। এরপর থেকে পদোন্নতি ও পদায়নের জন্য কর্মকর্তাদের জোটবদ্ধ হতে দেখা না গেলেও চাপ সৃষ্টি করা অব্যাহত রয়েছে বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে, যারা সাবেক সরকারের সময়ে পদোন্নতি পেয়েছেন, ভালো পদে দায়িত্ব পেয়েছেন, চুক্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন— তারা আছেন ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায়। ফলে কার্যক্রমে গতি আসছে না।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, যত বদলির সুপারিশ আসছে তার অর্ধেকের বেশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের জন্য। এরপরেই রয়েছে স্থানীয় সরকার, অর্থ, স্বাস্থ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের জন্য।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ-এপিডি অনুবিভাগ) মো: আব্দুর রউফ ৬ অক্টোবর টিবিএসকে বলেন, "জনপ্রশাসনে এরকম সময় কখনো আসেনি। ১৬ বছরের বঞ্চিতদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এখন তাদের পদায়ন করতে হিমশিম খাচ্ছি আমরা।"
তিনি বলেন, "পদায়নের ক্ষেত্রে নিয়ম কানুন যথাযথভাবে মেনেই করা হচ্ছে। আশা করা যায়, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে প্রশাসনের কার্যক্রম ও সামগ্রিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।"
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ৮ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫৩০ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর জনপ্রশাসনে প্রথম বড় পদোন্নতি হয় গত ১৩ আগস্ট। ওইদিন ১১৭ জন সিনিয়র সহকারী সচিবকে উপসচিব করা হয়। এর এক সপ্তাহের মধ্যে ২২৩ উপসচিবকে যুগ্ম সচিব করা হয়।
এরপর ২৫ আগস্ট ১৩১ কর্মকর্তাকে যুগ্ম সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব করা হয়। সব মিলিয়ে ৮ আগস্ট থেকে ২৫ আগস্ট সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার ৪৭১ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছে।
এরপরে যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিবসহ অন্যান্য পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে প্রায় ৬০ জনকে।
এদিকে, বুধবার ক্যাডার বহির্ভূত ১০ জনকে সহকারি সচিব করা হয়েছে।
৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১১ আগস্ট থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, চুক্তি বাতিল, বাধ্যতামূলক অবসর সংক্রান্ত ৬৫৫টি আদেশ জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। আর ৬ আগস্ট থেকে ৮ আগস্ট সময়ে জারি করে ২২টি আদেশ।
এসব আদেশের মধ্যে বদলির আদেশই সবচেয়ে বেশি।
জনপ্রশাসনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, "উভয় সংকটে পড়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। কারণ অনেকে পদোন্নতি পেয়ে এখন নতুন দপ্তরে পদায়ন চাচ্ছেন। অন্যদিকে, উপদেষ্টারা সবাইকে নিতে চাচ্ছেন না।"
"যাকে পদায়ন করা হবে তার বিস্তারিত তথ্য প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠিয়ে অনুমোদন করে নিয়ে তারপর পদায়ন করতে হচ্ছে। এমনকি, যে মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করতে হচ্ছে, সেই মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সম্মতি নিয়ে নিতে হচ্ছে," যোগ করে তিনি।