মোহাম্মদপুরে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানের নামে ডাকাতি: ফাঁস হলো যেভাবে
শুক্রবার (১১ অক্টোবর) দিবাগত রাত ৩টা; রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি আবাসিক ভবনের গার্ডকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দেওয়া একদল লোক।
সেনাবাহিনী এবং র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)- এর পোশাক পরা লোকেরা জানান, তারা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চালাতে এসেছেন। তাদেরকে সত্যিকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অফিসার মনে করে গেট খুলে দেন দায়িত্বরত গার্ড।
কিন্তু এরপর যা ঘটলো, তা হয়তো কারও কল্পনাতেও ছিল না।
তিন রাস্তার মোড় সংলগ্ন স্বপ্ননির হাউজিং-এ ব্যবসায়ী আবু বক্করের বাড়িতে এটি ছিল একটি পরিকল্পিত ডাকাতি।
গেট খুলে দেওয়ার পর দারোয়ানসহ ১৪–১৫ জন লোক বাড়ির তিন তলায় ব্যবসায়ী আবু বক্করের ফ্ল্যাটে যান। তারা বাসার ভেতরে প্রবেশ করে তাদের কাছে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় ধারালো অস্ত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন।
বাসায় অবৈধ অস্ত্র রয়েছে দাবি করে তারা আলমিরাহ, ওয়ারড্রব, সিন্দুক, শো-কেস ভেঙে ফেলেন।
ফ্ল্যাটের মালিক আবু বক্কর বলেন, "তারা প্রথমে আমাকে জিজ্ঞেস করে, কেন আমি আমার লাইসেন্স করা অস্ত্রটি থানায় জমা দেইনি।"
"কিন্তু আমি সেটি থানায় জমা দিয়েছি, বলার পরেও তারা আমার ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালাতে শুরু করে। পরে এক পর্যায়ে তারা আমার বাসা থেকে দুটি বস্তায় করে নগদ ৭৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং ৭০ ভরি স্বর্ণ লুট করে নিয়ে যায়," বলেন আবু বক্কর।
এছাড়াও, দুটি আইফোনসহ মোট তিনটি মোবাইল ফোন লুট করা হয় বলে জানান তিনি।
ভোর সোয়া ৪টার দিকে ডাকাতরা সমস্ত মামামাল নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। এ ঘটনায় পরের দিন শনিবার (১২ অক্টোবর) সকালে আবু বক্কর বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
গতকাল (১৩ অক্টোবর) এ মামলায় ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে সন্দেহভাজন ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
র্যাব ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীর পাঁচজন সাবেক সদস্যও রয়েছেন।
গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে এখন পর্যন্ত শরিফুল ইসলাম তুষার (৩৫), জাকির হোসেন (৩৭), মো. মাসুদুর রহমান (৪৭), আরিফ ইসলাম তরফদার (৩০), জাহিদ হাসান (৩৫) ও আবদুস সালাম (৫০) নামের ৬ জনের পরিচয় জানা গেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ৯ লাখ টাকা, স্বর্ণালংকার ও ডাকাতিতে ব্যবহৃত একটি মাইক্রোবাস উদ্ধার করেছে।
গতকাল রাতে মুঠোফোনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস জানান, "অভিযান চালিয়ে ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর চাকরিচ্যুত ৫ সদস্য রয়েছেন। গ্রেপ্তারকৃতদের থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে।"
অভিযানে লুট হওয়া ৭ লাখ টাকা, কিছু স্বর্ণালংকার এবং ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত একটি মাইক্রোবাসও জব্দ কর হয়েছে বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে, ডিবি পুলিশ অভিযান চালিয়ে এই ঘটনায় জড়িত আরও তিন জনকে গ্রেপ্তার করেছে বলে জানিয়েছে ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) তালিবুর রহমান।
তিনি বলেন, "ডিবির একটি টিম অভিযান চালিয়ে ব্যবসায়ীর বাসায় লুটের ঘটনায় তিন জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা, স্বর্ণালংকার ও দুটি লুণ্ঠিত আইফোন উদ্ধার করা হয়েছে।"
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পুলিশ পরিদর্শক তৌহিদুল ইসলাম বলেন, "এখন পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমি এখনো তদন্তের কাজে বাহিরে রয়েছি। জিজ্ঞাসাবাদের পর এই ঘটনার রহস্য উন্মোচিত হবে।"
পুলিশ জানায়, ডাকাতরা দুটি প্রাইভেট কার ও দুটি মাইক্রোবাসে করে, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এবং হেলমেট পরে এসেছিল। ফলে ভবনের দারোয়ান বুঝতে পারেননি, তারা আসলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নয়, বরং ডাকাত দল।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভুক্তভোগী আবু বক্কর মোহাম্পদপুর এলাকায় বড় ব্যবসায়ী। তিনি আবু কোম্পানি হিসেবে পরিচিত। তারা পাঁচ ভাই একসঙ্গে ব্যবসা পরিচালানা করেন। তাদের চারটি ইটের ভাটা, পাথর, কয়লা এবং আবাসন ব্যবসা রয়েছে। পুরো ব্যবসা দেখভাল করেন আবু বক্কর।
রোববার রাতে আবু বক্কর মুঠোফোনে টিবিএসকে বলেন, "আমি ৭৫ সাল থেকে ব্যবসা করি। আমার অস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে। সম্প্রতি থানায় অস্ত্র জমা দিয়েছি।"
"আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর পোশাক পরিহিত থাকায় আমি তাদের বিশ্বাস করেছিলাম। আমি অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই," যোগ করেন এই ভুক্তভোগী।