চলতি মৌসুমে শতকোটি টাকার ফুল বিক্রির আশা যশোরের চাষীদের
আসন্ন ভরা মৌসুমের বাজার ধরতে দম ফেলার ফুরসত নেই ফুলের রাজধানী খ্যাত যশোরের গদখালী এলাকার ফুলচাষীদের। গ্রীষ্ম-বর্ষার বৈরিতা পেরিয়ে শীতের অনুকূল আবহাওয়ায় সুদিনের স্বপ্ন বুনছেন এই অঞ্চলের সাত হাজার ফুলচাষী।
এবারের মৌসুমে বিভিন্ন দিবস-ঘিরে শত কোটি টাকার ফুলের বাণিজ্যের আশা করছেন তারা।
কৃষি বিভাগ বলছে, অনুকূল আবহাওয়ায় বাজার ভালো হলে প্রত্যাশা পূরণ হবে কৃষকদের।
যশোরের ঝিকরগাছার গদখালী অঞ্চলে বছরজুড়ে ফুলচাষ হলেও ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পাঁচমাস ফুলের ভরা মৌসুম। সাধারণত শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, মহান বিজয় দিবস, খ্রিস্টিয় নববর্ষ, বসন্তবরণ, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, মহান স্বাধীনতা দিবস ও বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে দেশে ফুলের চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। আর এসব দিবসকে টার্গেট করে গদখালীর চাষীরা ফুল আবাদ করে থাকেন।
চলতি বছরের গ্রীষ্মে অতি তাপমাত্রা আর বর্ষার অতিবৃষ্টির ধকল কাটিয়ে এবারের মৌসুমে চাষীরা শতকোটি টাকার ফুল বিক্রির স্বপ্ন বুনছেন।
পটুয়াপাড়া গ্রামের সুন্নত আলী দুই বিঘা জমিতে গোলাপ চাষ করেছেন।
তিনি জানান, "এ বছর অসময়ে বর্ষা হয়েছে। এখন জমিতে বাড়তি পরিচর্যা করছি। সামনের অনুষ্ঠানে দাম ভালো পেলে লাভ হবে।"
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির তথ্যমতে, যশোরে প্রায় ৭,০০০ ফুলচাষী রয়েছেন। তারা অন্তত ১২০০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রকার ফুল চাষ করেন। ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী, পানিসারা, নাভারণ, নির্বাসখোলার বিভিন্ন মাঠে ব্যাপক পরিমাণে ফুল চাষ হয়ে থাকে।
বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, জিপসি, রডস্টিক, ক্যালেন্ডোলা, চন্দ্র মল্লিকাসহ বিভিন্ন ধরনের ফুলের চাষ করা হয়।
দেশের মোট চাহিদার অন্তত ৭০ ভাগ ফুল সরবরাহ করেন যশোরের গদখালী অঞ্চলের ফুলচাষীরা।
তারা জানান, চলতি বছরের গ্রীষ্মে বেশ কয়েকবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড হয়েছে যশোরে। সেইসঙ্গে বর্ষা ঘিরে ছিল অতিবৃষ্টির দাপট। এসব কারণে গদখালীতে ফুলচাষীদের ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে তারা বর্তমানে ফুলক্ষেতের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।
ফুলচাষী সোহাগ হোসেন বলেন, "দেড় বিঘা জমিতে রঙিন গ্লাডিওলাস চাষ করেছি। বৃষ্টিতে অনেক গাছ মারা গেছে। প্রতি বিঘায় দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে। দাম ভালো না পেলে আমাদের ক্ষতি হয়ে যাবে।"
আরেক চাষী সিয়াম হোসেন বলেন, "ফুলক্ষেতে নতুন করে নিড়ানি দিয়ে সার ও কীটনাশক স্প্রে করা হয়েছে। এখন শুধু সেচ দিতে হবে। বাজার ভালো গেলে এ বছর অনেক লাভ হবে।"
জারবেরা চাষী মঞ্জুরুল আলম জানান, তার দুই বিঘা জমিতে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এ বছর ৭-৮ লাখ টাকার জারবেরা ফুল বিক্রির আশা করছেন তিনি।
ফুলমোড়ের ইসমাইল হোসেন বলেন, "এ বছর চাষীরা উৎসব ঘিরে বাড়তি ফুলের চাষ করেছিলেন। তবে দুইবার অসময়ের বৃষ্টির কারণে এলাকার সব ফুলচাষী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।"
এদিকে মৌসুমের শুরুতে ফুলের দামও উঠতে শুরু করেছে। প্রতিদিন কাকডাকা ভোরেই চাষীরা বিভিন্ন যানবাহনে তাদের উৎপাদিত ফুল নিয়ে আসছেন গদখালী বাজারে। ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাকে সরব হয়ে উঠছে ফুলবাজার।
যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের দুই ধারে বিভিন্ন জাতের ফুলের পসরা সাজিয়ে পাইকারি ক্রেতাদের অপেক্ষায় থাকছেন কৃষকরা। কেউ ভ্যান, কেউ সাইকেল, মোটরসাইকেল বা ঝুড়ির মধ্যে ফুল রেখে ঢাকা ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দামাদামি করছেন।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গদখালি বাজারে প্রতিটি গোলাপ বিক্রি হচ্ছে ৪ থেকে ৫ টাকা দরে, প্রতি পিস রজনীগন্ধা বিক্রি হচ্ছে ৬ টাকা। রঙিন গ্লাডিওলাস প্রতিটি মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ টাকা এবং জারবেরা বিক্রি হচ্ছে ১২ থেকে ১৪ টাকায়।
ফুল বাঁধাইয়ের জন্য কামিনীর পাতা বিক্রি হচ্ছে প্রতি আঁটি ৫০ টাকায়। জিপসির আঁটি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। মালা গাঁথার জন্য চন্দ্রমল্লিকা বিক্রি হচ্ছে প্রতি ১০০ ফুল ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়। গাঁদা ফুল বিক্রি হচ্ছে প্রতি হাজার ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়।
যশোর ফুল উৎপাদক ও বিপণন সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, "এ বছর সর্বোচ্চ তাপমাত্রার পর অসময়ে বৃষ্টিতে ফুলচাষীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে খ্রিস্টিয় নববর্ষ, বিজয় দিবস, বসন্তবরণ, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, মহান স্বাধীনতা দিবস ও বাংলা নববর্ষে ফুলের বাড়তি চাহিদা উপলক্ষে কৃষকরা ফুলচাষ করেছেন। সব ঠিক থাকলে এই অঞ্চল থেকে এ মৌসুমে শতকোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে।"
ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, এ বছর গ্রীষ্মকালে গরম ও অনাবৃষ্টি এবং বর্ষায় কয়েক দফায় ভারি ও টানা বৃষ্টিপাতের কারণে ফুলচাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে এখন আবহাওয়া অনুকূলে রয়েছে।
"চাষীরা এখন ক্ষেত পরিচর্যায় পুরোদমে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আবহাওয়া ও বাজার অনুকূলে থাকলে এই মৌসুমে (ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল) তারা ১০০ কোটি টাকার ফুল বেচাকেনার আশা করছেন। বছরজুড়ে এ অঞ্চলের কৃষকেরা প্রায় ১৫০ কোটি টাকার ফুল বেচাকেনা করে থাকেন," যোগ করেন তিনি।