আয়নাঘরে নির্যাতিতদের দুঃস্বপ্নের সেই সব দিন
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের মানুষের সামনে খুলেছে এক নতুন ভবিষ্যতের দুয়ার। এই ঘটনায় একই সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় 'আয়নাঘর' নামে পরিচিত গোপন কারাগারে রাজবন্দীদের ওপর অমানুষিক নির্যাতনের কাহিনি।
নির্যাতন সইতে না পেরে আয়নাঘরের কোনো কোনো বন্দী প্রায় পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। আবার কেউবা বরণ করে নিয়েছিলেন মৃত্যুকে।
হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর 'আয়নাঘর' থেকে ছাড়া পেয়েছেন কয়েকজন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর আক্রোশের শিকার হওয়ার গল্প শুনিয়েছেন। একসময় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতায় এলেও শেখ হাসিনা সময়ের সাথে সাথে স্বৈরাচারী মনমানসিকতা ও দমন-পীড়ন বেছে নেন। ক্ষমতায় টিকে থাকতে যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তিনি ব্যবহার করেন রাষ্ট্রযন্ত্রকে।
ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টায় জোরপূর্বক গুম করা ছিল শেখ হাসিনার নেওয়া কৌশলগুলোর অন্যতম। এ অপচেষ্টায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে অপহৃত শত শত মানুষের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব ব্যক্তিকে ধরা হয়েছে সাধারণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, যেমন বিক্ষোভ-সমাবেশ আয়োজন, রাস্তা অবরোধ, এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ায় বিক্ষুব্ধ কোনো মন্তব্য করার জন্য।
আওয়ামী শাসনামলে ভুক্তভোগীদের অনেককে মেরে ফেলা হয়েছে। অন্যদের কণ্ঠরোধ করতে আয়নাঘরের অন্ধকার ঘরে বছরের পর বছর আটকে রাখা হয়েছে। সেখানেও মারা গেছেন অনেকে।
আয়নাঘরের জীবন নিয়ে অনুভূতি প্রকাশ করা একজন মীর আহমেদ কাসেম আরমান। গত আগস্টে আয়নাঘর থেকে ছাড়া পান তিনি। বন্দীদের মধ্যে তার মতো আইনজীবী ছাড়াও ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, কূটনীতিক, এমনকি মানবাধিকারকর্মীরা।
আয়নাঘর থেকে মুক্ত বন্দীদের একজন কয়েকবার স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি মারা গেছেন ভেবে তার স্ত্রী আরেকজনকে বিয়ে করেছেন। মুক্তি পাওয়া আরেকজন জানতে পেরেছেন, তার খোঁজে বাবা কয়েক বছর মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে শেষমেশ মারা গেছেন।
আয়নাঘরে থেকে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা কত, তা এখনো অজানা। তবে গুম হওয়া ব্যক্তিদের বহু স্বজন আজও তাদের ফেরার অপেক্ষায় দিন গুনছেন। তাদের দাবি, নিখোঁজ স্বজনদের ফিরিয়ে দেওয়া হোক। আর না পাওয়া গেলে গুমের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার করা হোক।
নিখোঁজ স্বজনের অপেক্ষায় থাকা এমন ব্যক্তিদের একজন তাসনিম শিপরা। তিনি বলেন, "কী ঘটেছে, আমরা সেই জবাব চাই।'
তাসনিম জানান, তার চাচা বেলাল হোসেন ২০১৩ সালে নিখোঁজ হন। সম্ভবত তিনি আর এ দুনিয়ায় নেই।
সাবেক বন্দীদের তিনজনকে আয়নাঘরের একটা ছবি আঁকার অনুরোধ জানিয়েছিল দ্য টাইমস। তাদের আঁকা ছবিতে (স্কেচ) দেখা যায়, একটা লম্বা করিডর। আধা ডজন কক্ষ। একটি অপরটি থেকে দূরে, তবে মুখোমুখি। করিডরের দুই প্রান্তে টয়লেট। একটি দাঁড়িয়ে ব্যবহারের, অন্যটি বসার। প্রতিটি কক্ষে ছিল একটি বড় এগজস্ট ফ্যান। এমন ফ্যান থাকার কারণ, যাতে নিরাপত্তারক্ষীদের আলাপ শোনা না যায় এবং বন্দীদের মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত করে তোলা যায়।
'কয়েকজনকে একটা ছোট ভ্যানগাড়িতে তুলে শুইয়ে বেঁধে দেন রক্ষীরা'
কারারক্ষীরা একদিন ভোর হওয়ার আগেই আহমেদ কাসেম আরমানের কক্ষে ঢোকেন, ওই সময় তার মনে হয়েছিল, এ–ই মনে হয় সব শেষ।
আরমানকে জানালাবিহীন একটি কারাকক্ষে আট বছর বন্দী রাখা হয়েছিল। ওই কক্ষে একেকটা দিনও ছিল যেন অন্তহীন অন্ধকার রাত। তবে ওই দিনটা ছিল ভিন্ন রকমের। ভোরের আলো ফোটার আগেই নিরাপত্তারক্ষীরা কক্ষে ঢুকে তাকে নামাজ শেষ করতে বলেন। খুলে দেন চোখের পুরু বাঁধন। খুলে ফেলেন হাতকড়াও।
আরমান ভেবেছিলেন, তাকে মেরে ফেলে হয়তো লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হবে। নয়তো ডোবায় ফেলা দেওয়া হবে। সেদিন তিনিসহ আরও কয়েকজনকে একটি ছোট ভ্যানগাড়িতে তুলে শুইয়ে বেঁধে দেন রক্ষীরা। দুজনের নিচে লুকিয়ে রাখা হয় তাকে। তাদের নিয়ে গাড়ি ছুটে চলে এক ঘণ্টা।
কিন্তু দেশের অন্য অনেক রাজনৈতিক বন্দির মতো ভাগ্য বরণ করতে হয়নি মীর আহমেদ কাসেম আরমানকে। তিনি বলেন, তাকে নিয়ে রাজধানী ঢাকার একপ্রান্তে নির্জন মাঠে ফেলে চলে যান ওই নিরাপত্তারক্ষীরা।
মীর আরমানকে ২০১৬ সালে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য। যদিও তার বিরুদ্ধে কোনো অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল না। মূলত মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া মীর কাসেম আলীর ছেলে হওয়ায় তাকে আটকে রাখা হয়েছিল।
আরমান (৪০) বলেন, "দীর্ঘ অন্ধকার বন্দিজীবনে একটি বিষয়ই তাকে পাগল হওয়া থেকে বাঁচিয়েছে। তা হলো, তার স্ত্রী এবং বর্তমানে ১১ ও ১২ বছর বয়সের দুই কন্যার চিন্তা।"
তার কথায়, "আমি সব সময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি, এ পৃথিবীতে যদি আমাদের আর দেখা না–ও হয়, বেহেশতে যেন একত্র হতে পারি।"
'৪১ হাজারবার চোখ বাঁধা ও হাতকড়া পরানো হয়'
গোপন বন্দিশালায় বিরামহীন যন্ত্রণা ভোগের বর্ণনা দিয়েছেন আবদুল্লাহিল আমান আজমি। সাবেক উচ্চপদস্থ এই সেনা কর্মকর্তাকেও দৃশ্যত তার বাবার কারণে (বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রয়াত আমির গোলাম আজম) ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর তিনিও ওই সামরিক কারাগার (আয়নাঘর) থেকে ছাড়া পান।
আমান আজমি আট বছর বন্দী ছিলেন। আজমির অনুমান, ওই কয়েক বছরে অন্তত ৪১ হাজারবার তার চোখ বাঁধা ও হাতকড়া পরানো হয়েছে।
আমান আজমি বলেন, "আমি (বন্দিজীবনে) সৃষ্টিকর্তার আকাশ, চাঁদ, সূর্য, ঘাস, গাছপালা দেখিনি।"
তিনি আরও বলেন, "বন্দী হওয়ার পর প্রথম দিকে আমি দুটি ছোট ভেন্টিলেটর দিয়ে সূর্যের আলো দেখার চেষ্টা করি। কিন্তু সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ার পর তারা (কর্তৃপক্ষ) সেগুলো বন্ধ করে দেয়।"
জীবনধারণের মতো পরিবেশ না থাকা কারাগারটিতে চলত কঠোর নজরদারি। শারীরিক পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা হতো নিয়মিত। চুল কাটা হতো প্রতি চার থেকে ছয় মাসে একবার। জিজ্ঞাসাবাদের প্রাথমিক দিনগুলোয় চলত শারীরিক নির্যাতন। বেশি হতো মানসিক নির্যাতন।
'প্রতি শুক্রবার ভেসে আসত বাচ্চাদের গানের সুর'
কাতার ও ভিয়েতনামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মারুফ জামান। ২০১৯ সালে তিনি আয়নাঘর থেকে ছাড়া পান। এর আগে এ বন্দিশালায় এক বছরের বেশি সময় (৪৬৭ দিন) ছিলেন তিনি।
আয়নাঘরের ছবি আঁকার জন্য দ্য টাইমসের অনুরোধে মারুফ জামান গুগল ম্যাপ খুলে দেখান। জুম করলে দেখা যায়, ঢাকার একটি সামরিক ঘাঁটি। সেখানেই আয়নাঘরের অবস্থান। এ গোপন বন্দিশালার নাম প্রথম জানা যায় ২০২২ সালে বিদেশে বাংলাদেশি গণমাধ্যম নেত্র নিউজের একটি প্রতিবেদন থেকে।
মারুফ জামান ও মুক্তি পাওয়া অন্য বন্দিরা বলেন, তারা বন্দী অবস্থায় একটি সামরিক ঘাঁটিতে থাকার বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন। কেননা, ভোরবেলায় তারা সেখানে কুচকাওয়াজের শব্দ শুনতেন। জানতেন, ধারেকাছেই কর্মকর্তাদের আবাসিক ভবন আছে আর সেখানকার জীবনযাত্রাও স্বাভাবিক। সেখান থেকে প্রতি শুক্রবার ভেসে আসত বাচ্চাদের গানের সুর।
শেখ হাসিনার কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে তার ভারতীয় স্বার্থরক্ষার বিষয়ে সমালোচনা করতেন মারুফ জামান। আয়নাঘরে জিজ্ঞাসাবাদকালে তার মুখে অনবরত ঘুষি মারা হতো বলে জানান তিনি। এতে তার দুটি দাঁত পড়ে যায়।
জিজ্ঞাসাবাদকারীরা মারুফ জামানের সামনে সোশ্যাল মিডিয়া ও ব্লগে নিজের দেওয়া সব পোস্ট প্রিন্ট করে আনতেন। পোস্টগুলোর নির্দিষ্ট কিছু প্যারা সম্পর্কে জেরা করতেন।
জিজ্ঞাসাবাদকারীদের একজন জামানকে একদিন জিজ্ঞাসা করেন, "আপনার পোস্ট প্রিন্ট করতে আমরা অনেক অর্থ খরচ করেছি। আপনার বাবা কি এসব অর্থ আমাদের ফেরত দেবেন?"
'পাঁচ বছরের মধ্যে প্রথম দিনের আলো দেখলাম'
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অধিকারকর্মী মাইকেল চাকমা। আগস্টের কোনো এক দিন কয়েক ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে তাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় একটি জঙ্গলে ছেড়ে যাওয়া হয়।
মাইকেল চাকমা বলেন, "পাঁচ বছরের মধ্যে এই প্রথম আমি দিনের আলো দেখলাম। যখন দেখছিলাম, দুবার পরীক্ষা করছিলাম, আমি কি এ আলো স্বপ্নে দেখছি, না-কি বাস্তবেই।"
ঢাকায় ২০১৯ সালে একটি ব্যাংকে ঢোকার পর অপহৃত হন মাইকেল চাকমা। কারাগারের ভেতর তিনি জিজ্ঞাসাবাদকারীদের কাছে জানতে চাইতেন, কেন সেখানে তাকে রাখা হয়েছে। সবচেয়ে কাছাকাছি যে জবাব পেয়েছেন তা হলো, রাজনৈতিক প্রতিশোধ।
প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে শেখ হাসিনা নিজের দল আওয়ামী লীগের একটি সমাবেশে অংশ নিতে একবার চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন। সে সময় মাইকেল চাকমার দলীয় ছাত্রসংগঠন সড়ক অবরোধ করেছিল। সেদিন প্রধানমন্ত্রী হুমকি দিয়ে সমাবেশে তার বক্তৃতা শেষ করেন। বলেছিলেন, এ বিক্ষোভের পেছনে যারা রয়েছেন, তাদের তিনি দেখে নেবেন।
মাইকেল চাকমা বলেন, "ওই ঘটনা তাকে (শেখ হাসিনা) ক্ষুব্ধ করেছিল। আমি সব সময় তাদের কাছে জানতে চাইতাম, আমার কী অপরাধ? আমি কী করেছি? আমি কি দোষী? তারা বলতেন, আওয়ামী লীগ সরকারকে নিয়ে আমি অসৎ উদ্দেশ্যে রাজনীতি করছি।"
সাবেক সেনাকর্মকর্তা আজমি সাক্ষাৎকারে আয়নাঘরে চালানো নির্যাতন প্রসঙ্গে দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, "বড় কাপড় দিয়ে কখনো কখনো তার চোখ এমনভাবে বাঁধা হতো যে নাক আটকে গিয়ে শ্বাস নিতে কষ্ট হতো। ব্যথা হতো চোখেও। আবদ্ধ ঘরে থেকে থেকে ক্ষয়ে যায় তার দাঁত, ত্বকে দেখা দেয় ঘা।"
এত সব নির্যাতনের বাইরেও সারাক্ষণ একটা আতঙ্ক তাঁকে তাড়া করে বেড়াত বলে জানান আজমি। তিনি বলেন, তার মনে হতো, একদিন রাতে তাকে বাইরে নিয়ে হত্যার পর কোথাও ফেলে দেওয়া হবে। আর পরদিন পত্রিকার পাতায় গল্প ছাপা হবে, পুলিশের সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হয়েছেন তিনি।
আজমি বলেন, তিনি সৃষ্টিকর্তার কাছে মনেপ্রাণে চাইতেন, তার মরদেহ যেন কুকুর–বিড়ালে খেয়ে না ফেলে। মরদেহ যেন তার পরিবার ও স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
এক সংবাদ সম্মেলনে আজমি বলেছেন, "যে অপমান ও যন্ত্রণা আমি ভোগ করেছি, তা কোনো ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়।"
আইনজীবী আরমানকে ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে তার স্ত্রী ও চার বছর বয়সী কন্যার সামনে থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। আপাতদৃষ্টে, এমন কাজের জন্য তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, যার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন না।
আরমানকে তার বাবা মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার কিছুদিন আগে আটক করা হয়েছিল। একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল হাসিনা সরকার। ১৯৭১ সালে মীর কাসেম আলী জামায়াতে ইসলামীর কিশোর বয়সী ছাত্রনেতা ছিলেন। ওই সময় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল দলটি।
ব্যাংক, গণমাধ্যম ও হাসপাতালের মালিক মীর কাসেম আলীকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের জন্য হুমকি হিসেবে দেখেছিলেন।
আরমান বলেন, "আমি বাবার একাত্তরের ভূমিকার জন্য গর্বিত নই।" তবে এই আইনজীবী দাবি করেন, তার বাবা এক দিনের জন্যও কারাগারে থাকার উপযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন না; আর মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য তো ননই।
বছরের পর বছর যন্ত্রণা ও অনিশ্চয়তা কাটিয়ে শেষমেশ আরমান তার স্ত্রী, দুই কন্যা ও মায়ের সঙ্গে আবার একত্র হতে পেরেছেন। এর আগে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে তাকে। তবে বাবাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় হারিয়ে যাওয়া, নিঃসঙ্গ বন্দিজীবন কাটানো—জীবনকে বিধ্বস্ত করে দেওয়া এসব ঘটনা তাকে তাড়া করে বেড়ায়।
শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর নারী–পুরুষের ছোট একটি দল রাস্তায় লাখো উল্লসিত জনতার ঢেউ ঠেলে হাজির হয়েছিল সেনা সদর দপ্তরের ফটকে। ঐ দলে এমন কিছু ব্যক্তি ছিলেন, যারা আওয়ামী আমলে জোরপূর্বক গুমের শিকার হয়েও বেঁচে যান।
তাদের একজন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসিনুর রহমান। দেড় বছর নিখোঁজ ছিলেন তিনি। এই সাবেক সেনা কর্মকর্তা আয়নাঘর প্রসঙ্গে বলেন, "আমরা দিন–রাত ঘুমাতে পারতাম না। লোকজন কাঁদত, চিৎকার করত, তাদের নির্যাতন করা হতো।"
ফটকে হাজির হওয়া নারীরা খুঁজছিলেন তাদের হারানো স্বজনদের। তারা অনেক বছর ধরেই স্বজনের সন্ধানে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। জীবিত না পেলেও তারা চান স্বজনের মরদেহের সন্ধানটুকু পেতে।
এ ঘটনার পর কয়েক দিনে ফিরে এসেছেন আরমান, আজমি ও মাইকেল চাকমা। তাদের এ মুক্তি গুমের শিকার অন্য ব্যক্তিদের মা, বোন, স্ত্রী–কন্যাদের মনে আশা জুগিয়েছে।
ঢাকা সেনা সদর দপ্তরের মতোই দেশের অন্যান্য অংশে বিভিন্ন সেনাঘাঁটির বাইরে হারানো স্বজনদের খোঁজে ভিড় করেছিলেন অনেকে। তাঁদের সবার প্রশ্ন, "আমাদের প্রিয় মানুষ কোথায়?" স্বজন হারানো এসব ব্যক্তি যেখানেই সমবেত হোন না কেন, তাদের দাবি, 'বন্ধ করা হোক এসব আয়নাঘর'।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বলপূর্বক গুমের বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। একইসাথে বাংলাদেশে এ সম্পর্কিত অপরাধ তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। যার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্তের জন্য গঠিত একটি বিশেষ আদালত বিদেশে নির্বাসিত হাসিনার জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।