পর্যটন ও সংরক্ষণের ভারসাম্য: কঠিন পরীক্ষার মুখে সেন্ট মার্টিন
প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের পরিবেশ রক্ষায় সেখানে পর্যটক সংখ্যা সীমিত করার সরকারি যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা দ্বীপের স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পরে বলে উদ্বেগ জানিয়েছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা।
বিনিয়োগকারীরা বলছেন, এ সিদ্ধান্তের কারণে সেন্ট মার্টিনে ২০০ হোটেল ও রিসোর্ট এবং ১৫০ রেস্তোরাঁয় ১,০০০ কোটি টাকার পরিকল্পিত বিনিয়োগ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। কারণ এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে আসন্ন পিক সিজনে পর্যটকের সংখ্যা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের স্বার্থে গত মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) সরকার দ্বীপটিতে পর্যটকের সংখ্যা সীমিত করার সিদ্ধান্তের কথা জানায়।
এই সিদ্ধান্তের আওতায় নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এই চার মাস সেখানে পর্যটক সীমিত থাকবে।
নভেম্বর মাসে পর্যটকরা যেতে পারবেন, কিন্তু রাতযাপন করতে পারবেন না। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে প্রতিদিন দুই হাজারের বেশি পর্যটক সেন্টমার্টিন যেতে পারবেন না। আর ফেব্রুয়ারি মাসে সেন্টমার্টিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজে পর্যটক যাওয়া বন্ধ রাখা হবে।
এর আগে, পর্যটকরা অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত দ্বীপটিতে ভ্রমণের সুযোগ পেতেন। সপ্তাহান্তে প্রতিদিন ৬,০০০ পর্যটক যাওয়ার অনুমতি ছিল।
সেন্ট মার্টিন পরিবেশ ও পর্যটন ঐক্য উন্নয়ন জোটের সভাপতি শিবলুল আজম কুরেশী বলেন, "সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে অনেক পর্যটক কক্সবাজার আসেন। এখন যদি সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার সুযোগ না থাকে, তাহলে তারা কক্সবাজারেও যাবেন না। এতে কক্সবাজারের পর্যটন ব্যবসাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।"
"সেন্ট মার্টিনের পর্যটনকে ঘিরে অন্তত ৬,০০০ লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে। এছাড়া, স্থানীয় অধিবাসীদের অনেকে স্ট্রিট ফুড বিক্রি, হকার হিসেবে বা রকমারি পণ্য বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। এসব বিবেচনায় না নিয়ে এভাবে পর্যটক সীমিত করাতে তাদের জীবিকায় বড় ধরনের টান পড়বে," যোগ করেন তিনি।
উদ্যোক্তারা চান, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পুরো পিক সিজনেই যেন পর্যটকরা সেন্ট মার্টিনে রাতযাপন করতে পারেন। আর মার্চ মাসে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো যেতে পারে।
শিবলুল আজম কুরেশী বলেন, "গড়ে অন্তত ৪,০০০ পর্যটককে রাতে থাকার অনুমতি দিতে হবে। তা না হলে সবাই পথে বসবে।"
ট্যুর অপারেটর, স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অসন্তোষ
সেন্ট মার্টিন দেশের বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত এ দ্বীপ দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। পর্যটকদের ভিড় বাড়তে থাকায় সেন্টমার্টিনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।
অতিদ্রুত পর্যটকদের স্রোত ঠেকানো না গেলে এই দ্বীপের পরিবেশে ভারসাম্য ফেরানো রীতিমত অসম্ভব হবে বলে মনে করেন পরিবেশবাদীরা। ফলে সেন্ট মার্টিনের জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় সেখানে পর্যটক সংখ্যা সীমিত করার দাবি বহুদিনের।
যদিও পরিবেশবাদীদের এই দাবি ও সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন ট্যুর অপারেটর, স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের নীল হাওয়া রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল্লাহিল মামুন নিলয় বলেন, "কোনো ধরনের ফিজিবিলিটি স্টাডি না করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার মানে নেই। কারণ স্থানীয়রা মাছ ধরা কিংবা ট্যুরিজমের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু মাছ ধরে তারা খুব বেশি লাভ করতে পারে না। তাই ট্যুরিজমের সুযোগ না থাকলে তাদের জন্য পরিস্থিতি অনেক কঠিন হয়ে যাবে।"
পরিবেশ রক্ষা ও সুযোগ-সুবিধা তৈরিতে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদকে ঢেলে সাজানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, "প্লাস্টিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, সরু সড়কগুলোকে যাতায়াতের জন্য উপযোগী করা-সহ সার্বিক কাজে ইউপির সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। এসব কাজে এনজিওগুলোকেও যুক্ত করা যায়।"
এদিকে, সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলনের ডাক দেয় ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব)।
এর আগে, টোয়াব সভাপতি মোহাম্মদ রফিউজ্জামান পিক সিজনকে সামনে রেখে সেন্ট মার্টিনের পর্যটনকে প্রভাবিত করতে পরে— এমন যেকোনো 'নেতিবাচক সিদ্ধান্তের' বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন।
দ্বীপে পর্যটন সীমিত করার ক্ষেত্রে তিনি ব্যাপক নীতিমালা তৈরির প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছিলেন।
জীবিকা ও অর্থনীতির উপর প্রভাব
খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, সেন্ট মার্টিনে পর্যটন সীমিত করলে তা শুধু সেখানকার স্থানীয় জীবিকাকেই হুমকির মুখে ফেলবে না, বরং চলমান বিনিয়োগ এবং সামগ্রিক পর্যটন খাতকেও প্রভাবিত করবে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ, এই নিষেধাজ্ঞায় নিরুৎসাহিত হবেন পর্যটকরা, যার প্রভাব পড়বে কক্সবাজার-সহ বৃহত্তর পর্যটন খাতে।
সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় সেন্ট মার্টিন পরিবেশ ও পর্যটন ঐক্য উন্নয়ন জোট দ্বীপের পর্যটন শিল্প ও সেখানকার প্রায় ৮,০০০ বাসিন্দার জীবিকা রক্ষায় ১৯ দফা দাবি তুলেছে।
তারা একটি টেকসই পর্যটন মডেলের পক্ষে যুক্তি দিয়েছে, যা স্থানীয় বাসিন্দাদের অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি পরিবেশ সুরক্ষার ভারসাম্যও বজায় রাখবে।
খাত সংশ্লিষ্টরা সরকারকে তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন; যাতে করে পরিবেশ সংরক্ষণের সাথে দ্বীপের স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের জীবিকা রক্ষার বিষয়টিও গুরুত্ব পায়।